দেশজুড়ে সংখ্যালঘু ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের ক্ষতিপুরণের দাবি

দেশজুড়ে সংখ্যালঘু ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের ক্ষতিপুরণের দাবি
এফএনএস (মোঃ রিয়াজুল ইসলাম; দিনাজপুর)

25 Jan 2015 06:15:05 PM Sunday BdST
201K A- A A+ Print this E-mail this
দেশজুড়ে সংখ্যালঘু ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের ক্ষতিপুরণের দাবি
দেশজুড়ে দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা, দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং নির্যাতিতদের সহযোগিতার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ দলিত ও মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার ফোরাম, দিনাজপুর জেলা কমিটি। গতকাল রোববার সকালে দিনাজপুর প্রেস ক্লাবে বেসরকারি সংস্থা শারি’র সহযোগিতায়্ আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের জেলা আহ্বায়ক এবং দিনাজপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেসমিন আরা জ্যো¯œা লিখিত বক্তব্যে বলেন, রাজনীতিক ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে বাংলাদেশে দলিত ও সংখ্যালঘু নির্যাতন একটা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্যাতন বন্ধের পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে তা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের উৎকণ্ঠা দূর হচ্ছেনা।
দিনাজপুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আদর্শ জেলা দিনাজপুরকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হতো। হিন্দু, মুসলিম,বৌদ্ধ, খৃষ্টান, সাঁওতাল, উড়াও, হরিজন,ঋষি, ডোম সহ সকল ধর্মীয় ও নৃতাত্মিক জনগোষ্ঠীর মিলন মেলা এই দিনাজপুর। কিন্তু রাজনীতিক ও অন্যান্য কারণে প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দিনাজপুর জেলায়ও দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলার অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নে দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের উল্লেখ করে জেসমিন আরা জ্যো¯œা বলেন, ঐ সময় ঐ ইউনিয়নের রঘুনাথপুর, শিকারপুর, সরাহার, বড়োয়া বন্ধুগাঁও সহ বিভিন্নগ্রামে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। রাজনীতিক দুর্বৃত্তদের ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে তখন ঐসব গ্রামের অনেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেন নাই।
জেসমিন আরা জ্যো¯œা বলেন, আশা করা হয়েছিল যে, আর হয়তো কখনো দিনাজপুর জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটবেনা। কিন্তু ২০১২ ইং সালের ৪ আগস্ট চিরিরবন্দরের বলাই বাজারে এবং এর আশেপাশের গ্রামগুলোতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর রাজনীতিক সন্ত্রাসীদের সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা আবারো দিাজপুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার গৌরবগাঁথা কলংকিত হয়। সেই হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়েূর অনেকের ঘর-বাড়িতে আগুন, লুটপাট, মারধর করা হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিনাজপুরবাসী আশা করেছিলেন যে, প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কার্যকর প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই কলংকের দাগ মুছে যাবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই দাগতো মুছেই নাই বরং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে শান্ত ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিনাজপুরকে আরো অশান্ত করে তোলা হয়। ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে খানসামার ভাবকী ইউনিয়নাধীন রামনগর, ফোকাসাপাড়া, মন্ডলপাড়া, কাচিয়ানী বাজার, কালির বাজার এবং চিরিরবন্দর উপজেলার ভূষিরবন্দর ও রাণীরবন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, ধানের পুঁজে এবং ধান ও আঁখ ক্ষেতে হামলা চালানো হয়। হামলাকারী দুর্বৃত্তরা তাণ্ডব চালিয়ে সেই রাতে গ্রামটির ফোকাসাপাড়া নিবাসী গৌরহরি শাহ’র ১০০বিঘা জমির ১৬টি ধানের পুঁজসহ বাইরের খোলানে থাকা ৫টি ঘর, নিখিল চন্দ্র রায়ের ২টিশোয়ার ঘর সহ ঘরের সমস্ত মালামাল, নিরঞ্জন রায়ের দুইটি ঘরের সমস্ত মালামাল, রামনগর-মন্ডলপাড়া নিবাসী ফনীন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি ও ধানের পুঁজে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেই রাতেই ভুষিরবন্দরে ব্যবসায়ী ও দিনাজপুর জেলা মোটর পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ভবানী শংকর আগরওয়ালার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালানো হয়। তার ৭টি ট্রকে আগুন লাগিয়ে জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়। ২টি গোডাউন ভর্তি সারসহ কোটি টাকার মালামাল লুট করা হয়। চিরিরবন্দরের ১১নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল কুমার সাহার ২০বিঘা জমির ধান আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলাকারীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে বেদম মারধরও করে। তারা ৪নং খামারপাড়া ইউনিয়নের দঃ বালাপাড়া বটেরহাটে অবস্থিত গৌরহরি শাহ’র হাসকিং মিলের মিটার, মর্টার ও বারান্দার চালা ভেঙে ফেলে। কালির বাজারে অবস্থিত নিরঞ্জন রায়ের ঔষুধের দোকান ভেঙে তছনছ করে। এই জঘন্য ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম সংসদ নির্বাচনের দিন নির্বাচনি ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুর্বৃত্তরা সংঘবদ্ধভাবে দিনাজপুর সদর উপজেলার কর্ণাই, সাহাপাড়া, তেলিপাড়া, প্রীতমপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায়। এখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের সমর্থক কয়েকটি মুসলিম পরিবারসহ প্রায় দেড়শত সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর,লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাজনীতিক দুর্বৃত্তরা ৫ জানুয়ারি নির্বাচন চলাকালে হামলা চালায় চিরিরবন্দরের অকড়াবাড়ী (খোচনা), বীরগঞ্জের লাডডাবরাসহ আরো কয়েকটি এলকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
সংবাদ সম্মেলনে দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর সকল ধরনের হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং হামলা ও নির্যাতনের সাথে জড়িত সকল দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে খানসামার রামনগর, চিরিরবন্দরের রানীরব্দর, ভূষিরব্দর, অঁকড়াবাড়ীর (খোচনা) ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ প্রদান, কর্ণাইয়ের সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি পরোক্ষ হুমকিদাতাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা, বিরলের মঙ্গলপুরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং নবাবগঞ্জ উপজেলার ঢুডু সরেনের হত্যাকারীদের গ্রেফতারসহ ও দলিত, নৃতাত্মিক, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ভূমিদস্যুদের হাত হতে রক্ষার দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বাংলাদেশ দলিত ও মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার ফোরাম, দিনাজপুর জেলা কমিটির সদস্যসচিব ও মিডিয়া ডিফেন্ডার আজহারুল আজাদ জুয়েল। সংবাদ সম্মেলনে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ- দিনাজপুর জেলা কমিটির সভাপতি পরিমল চক্রবর্তী তপন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট- দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতান কামালউদ্দীন বাচ্চু, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ- দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল মতিন সৈকত, নজরুল পরিষদ-দিনাজপুর এর সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দীন আহমেদ রয়েল। বাংলাদেশ দলিত ও মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার ফোরাম, দিনাজপুর জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও মমতা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব আলী, যুগ্ম আহ্বায়ক ও মহুয়ার নির্বাহী পরিচালক নুরুন নাহার, সদস্য ও দিনাজপুর সংগীত কলেজের শিক্ষক বদিউজ্জামান বাদল, বাংলাদেশ দলিত পঞ্চায়েত ফোরাম- দিনাজপুর জেলা কমিটির সভাপতি শিউ পুজন দাসসহ জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্র এবং টিভি ও অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।