নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতারোধের বিষয়টি নিশ্চিত করে ভোট প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে : কাজী রিয়াজুল হক

নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতারোধের বিষয়টি নিশ্চিত করে ভোট প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে : কাজী রিয়াজুল হক
Dalitkantha Posted on বুধবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ কার্তিক ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বাচনকেন্দ্রিক নির্যাতন ও সহিংসতারোধে দলমত নির্বিশেষে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি সংযুক্ত রাখার পাশাপাশি তা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্যাতনরোধে রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকলেও দেশের প্রধান প্রধান দলগুলোকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কোন না কোন দলের ছত্রছায়াতেই নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। বিগত সময়ের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান না করায় নির্যাতনকারীরা বারবার সহিংস ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয়ে আসছে। এই প্রবণতারোধ করা না গেলে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটতেই থাকবে। উন্নয়নের সঙ্গে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। মানুষের প্রতি থাকতে হবে শ্রদ্ধা। তাহলেই সার্থক হবে উন্নয়ন এবং দেশের মানুষ তা নিরাপদে ভোগ করে হাসিখুশিতে থাকবে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে মানবাধিকার সংস্থা ‘শারির’ ‘জাতীয় নির্বাচন ’১৮ ও সংখ্যালঘু নিরাপত্তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকবৃন্দ এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসিবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

শারির নির্বাহী পরিচালক প্রিয়বালা বিশ্বাসের সভাপতিত্বে ও দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের যুগ্ম সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, রিইব এর নির্বাহী প্রধান মানবাধিকারকর্মী ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ সভাপতি নির্মল রোজারিও প্রমুখ।

নির্বাচনকালীন সময়ে এবং নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুদের ওপর হয়রানি হয়ে থাকে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে মনে করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। রাশেদ খান মেনন বলেন, পাকিস্তান শাসনামল থেকেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলে আসছে, যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনও আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটছে। স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে, বিশেষ করে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। নির্বাচনের যে প্রার্থী জয়ী হোক না কেন তার নিজ এলাকায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারণায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। জামায়াত-বিএনপি এদেশে ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশে একটি অস্বস্তির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সেই ঘটনার অবসান ঘটানো হয়েছে। তবে এখন সমাজের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা বিভিন্ন জায়গায় সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সচেতন বলেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য অনেক আইন রয়েছে। সংবিধানের ২৮-এর ৪ ধারায় বলা আছে নারী-শিশু ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আইন হতে পারে। এখন বাংলাদেশে নারী-শিশুদের নির্যাতন রোধে আইন রয়েছে তাই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন রোধেও আইন হতে পারে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এখনও পর্যন্ত দেশে জাতীয় নির্বাচনের সময় নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। এটা নির্বাচনী কাজের সঙ্গে জড়িতদের ব্যর্থতা। সংখ্যালঘুদের হতাশ হলে চলবে না, নিজেদের দাবি আদায়ে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন রোধে রাষ্ট্র, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন হতে হবে। এবং প্রতিটি এলাকায় নিজ নিজ থেকে সভা করে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সংখ্যালঘু নয়, সকলকে বাঙালী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দুর্গ গড়তে হবে। যেসব জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে, সে সব জেলা ও এলাকাগুলোতে এ বিষয়ে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে।

সকলের সমান অধিকার উল্লেখ করে মানবাধিকার চেয়ারম্যান বলেন, কাউকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সকলেই যুদ্ধ করেছি। সংবিধানে সকলের সমান অধিকারের বিষয়টি লিপিবদ্ধ রয়েছে। বৈষম্য বিলোপ আইন তৈরি করা দরকার বলে মনে করেন মানবাধিকার চেয়ারম্যান।

দেশে আইন লংঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সংবিধান ও আইনে নিরাপত্তার বিষয়টি সংরক্ষিত থাকার পরও দেশে নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক সময় আইন বাস্তবায়িত হয় না। নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতারোধের বিষয়টি নিশ্চিত করে ভোট প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে।

দেশের উন্নয়নের বিষয়টি তুলে ধরে মানবাধিকার চেয়ারম্যান বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। মানুষের প্রতি থাকতে হবে শ্রদ্ধা। তাহলেই সার্থক হবে উন্নয়ন এবং দেশের মানুষ তা ভোগ করে হাসি খুশিতে থাকবে।

অ্যাড. সুলতানা কামাল বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘুরা জীবন-মরণ খেলায় দোলে। নির্বাচন কারও জন্য হয় উৎসবমুখর আবার কারও জন্য হয় আতঙ্কের। তাই সব রাজনৈতিক দলকে সংখ্যালঘুদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। আগামী নির্বাচনে কোন সাম্প্রদায়িক ব্যাক্তিকে কেউ মনোনয়ন দিবেন না। কারণ ওই সব সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরাই সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়। যদি দেয়া হয়, তাহলে তাকে প্রতিরোধ করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ও সংখ্যালঘুদের প্রস্তুত থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে সংখ্যালঘুদের কাছে ভোট ভিক্ষা করতে গিয়ে বলে আমাদের সহযোগিতা করুন আমরা আপনাদের মঙ্গলে কাজ করব কিন্তু নির্বাচনের পর দেখা যায় চাঁদাবাজি, আর ভোগ দখলে মরিয়া। যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেন। গণতন্ত্রের কথা বলেন। তারা ৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কিভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ করেছে।

তিনি বলেন, আজও বৈষম্য বিলোপ আইন পাস হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর করা অঙ্গীকার, ভেঙে ফেলা মন্দির, পুরনো মন্দির সংস্কার করার জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের বাস্তবায়ন আজও হয়নি। অর্পিত সম্পত্তি আইনের বাস্তবায়ন নেই। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আমরা ছেড়ে দিব না। সব আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলব। নিজেদের অধিকার আদায়ে অনড় থাকব, প্রতিবাদ করব। একটি সাম্যের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ও সমঅধিকারের বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই।

দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান বলেন, শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নয়। প্রতিদিন সারাদেশের কোন না কোন অঞ্চলে মন্দির ভাঙা হচ্ছে, সম্পদ দখল হচ্ছে কিংবা সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। নির্বাচন আসলে তুলনামূলকভাবে এই নির্যাতনের মাত্রাটা বেড়ে যায়। তখন দলীয় মদদে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ভোটের রাজনীতিটা তখন অসুস্থ হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, দেশের কোন রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ধারণ করে না। এমনকি বর্তমান সরকারও না। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সরকার হেফাজতের কাছে কিভাবে আত্মসমর্পণ করে যেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিল, যে মাঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর এদেশের রাজনীতি পাকিস্তানি ধারায় চলে গেছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের দলও তাদের সঙ্গে আপস করছে। নয়তো পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতি ভূত। নারী নীতিতেও তাদের মতের প্রতিফলন।

এসময় তিনি প্রস্তাবনা পেশ করে বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের নেতৃতত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রধান ও নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থার সঙ্গে বসে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান করার উপায় বের করতে হবে। এবং নির্বাচনের সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, নির্বাচন এলেই সাম্প্রদায়িক উসকানি দিতে থাকেন অনেকে। আমরা ভুলি নাই সেই শাবাশ বাংলাদেশের কথা, যেখানে একজন রাজনীতিবিদ দলকে জেতাতে একহাতে কোরান আর অন্য হাতে গীতা নিয়ে বলেন, আপনারা কাকে জেতাতে চান? জাতি এসব ভোলে নাই যে, একজন দলপ্রধান বলেন, অমুক দল জিতলে মসজিদ থেকে আজান নয় উলুধ্বনি আসবে, শঙ্খধ্বনি আসবে। এবার যাতে এসব না হয়।

তিনি বলেন, সরকার ১ থেকে ২ পারসেন্ট ভোটের জন্য জেএসসি পরীক্ষা স্থগিত করতে পারেন। কিন্ত ১০ থেকে ১১ পারসেন্ট ভোটের জন্য তিনি কি পদক্ষেপ নেবেন। তা জানাবেন।

ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করা দুর্ভাগ্যজনক। এই দেশ স্বাধীন হয়েছে সবার জন্য, কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ কেন অস্তিত্বের জন্য লড়াই করতে হবে। সামনের জাতীয় নির্বাচনে যেন কোন দল ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য সকলকে নিজ নিজ থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘু নির্যাতন সংক্রান্ত ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। অনুষ্ঠানে দিনাজপুর এবং বরিশালে ২০০১ এবং ২০১৪ সালে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের এলাকার থেকে নির্যাতনের শিকার রনজিত কুমার রায়, পুরেন দাস, সংবাদকর্মী কল্যাণ কুমার চন্দ, সংবাদকর্মী আজহারুল আজাদ জুয়েল এবং খালেদা আক্তার হেনা তাদের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন।