অধিকাংশ আদিবাসীই দলিত কিন্তু সব দলিত আদিবাসী নয়

আদিবাসী ও দলিত শব্দটি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে তর্ক-বির্তক হয়ে আসছে। পাশাপাশি দলিত শ্রেণীর লোকেরা এক ধরনের বিবৃতি দিচ্ছেন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্য ধরনের বিবৃতি উপস্থাপনা করছেন। অর্থাৎ সরকারি ও বিরোধীদলের মতো একে অপরের প্রতি যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি তর্ক দিচ্ছেন। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে তাহলে ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে এবং পরস্পর পরস্পরের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। এর ফলে সমাজে ঐক্যতা বিনষ্ট হবে, ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হবে। আদিবাসীদের মধ্যে ও দলিতদের মধ্যে যাতে এই তিক্ততা ছড়িয়ে না পড়ে তার নিরসন হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এই দেশে বহু সম্প্রদায় বসবাস করে। এর মধ্যে রয়েছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ইত্যাদি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়। তারা চাকরি-বাকরি, শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গরিমায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে। কিন্তু মুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে ও বহু লোকজন পেটপুরে ক্ষেতে পারে না। তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। যেমন_ হাজাম, শেক, বাইদ্যা, জেলে, পাটনি, ধোপা, নাপিত ইত্যাদি। এসব সম্প্রদায়ের লোকেরা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু বলে তাদের সঙ্গে অবস্থাসম্পন্ন (ধনী) লোকেরা ওঠাবসা করে না, তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। তাদের বড় বড় অনুষ্ঠানে এবং ধর্মীয় কার্যকলাপে এক সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় না। যদিও তারা একই ধর্মের অনুসারী এবং নিকটতম প্রতিবেশী। এসব লোকদের মধ্যে যারা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমায় বিজ্ঞানে ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনগ্রসর তাদেরই আমরা মুসলিম দলিত বলি।

সংখ্যালঘু (গরহড়ৎরঃরবং) : সংখ্যালঘু জাতি বলতে যারা দেশের মধ্যে সংখ্যায় কম এবং যারা বিভিন্ন অধিকার হতে বঞ্চিত অনগ্রসর ও পিছে পড়া জনগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে সংখ্যালঘু বলা যায়। অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী (ইধপশধিৎফং) : অন্ত্যজ শব্দের বিপরীত অর্থ অগ্রজ। অর্থাৎ সমাজে যারা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সর্বক্ষেত্রে পেছনে পড়ে আছে এবং সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, উন্নয়নের ছোঁয়া যাদের গায়ে আজও স্পর্শ করেনি এবং অস্পৃশ্যতার শিকার তারাই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী বলে পরিচিত। দলিত (উধষরঃ) : দলিত একটি মারাঠি শব্দ যার অর্থ হলো যে ভেঙে পড়েছে। অর্থাৎ দলিত শব্দ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, এ সম্প্রদায়ের মানুষ সামাজিক বর্ণ ও বৈষম্যে একেবারে নিষ্পেষিত। আম্বেদকরের মতে, যাদের কিছু নেই তারা সর্বহারা, আর যাদের কিছু নেই তারা দলিত। বাংলায় দলিত শব্দের অর্থ নিষ্পেষিত, মোথিত, অর্থনৈতিকভাবে যারা পঙ্গু এবং যারা দলনের শিকার এবং বৈষম্যের ও অস্পৃশতার শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তারাই দলিত। যে কোন সম্প্রদায়ের লোক দলিত হতে পারে। দলিত শব্দটি একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তুলে ধরে, যাদের মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় বিচিত্র জনগোষ্ঠী, যারা ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ইত্যাদি। হরিজন : হরিজন শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় হরি মানে ভগবান এবং জন মানে বান্ধা বা ভক্ত। অর্থাৎ ভগবানের বান্দা বা পুত্র (ঈযরষফ ড়ভ এড়ফ)। সমাজে অস্পৃশ্য জাতিদের হরিজন নামটি দিয়েছিল গড়যধহফধং কধৎধস পযধহফ মধহফযর ব্রিটিশ শাসনের সময় উঁচু ফ্লামের মানুষেরা গরিব, দুঃখী অসহায় দরিদ্র মানুষদের ইন্ডিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে পরিষ্কার করার কাজ, ঝাড়ু দেয়ার কাজ এবং তাদের বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন শহর পরিচ্ছন্ন করার উদ্দেশ্যে। মনে করা হয় ওই সময়ই তারা হরিজন বলে চিহ্নিত হয়েছিল ব্রিটিশ পিরিয়ডে। আমাদের দেশে আনুমানিক ৩০ লাখ আদিবাসী বসবাস করে। এসব আদিবাসী সমপ্রদায়ের লোক সমগ্র দেশে ক্ষুদ্রভাবে অঞ্চলে অঞ্চলে বসবাস করে। আদিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ লোকজন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু দিন আনে দিন খায় পেটপুরে কোন দিন তারা খেতে পায় না। যারা অপুষ্টির স্বীকার এবং শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছে। এসব ব্যক্তিকেই আমরা আদিবাসী দলিত বলি। আর যারা আদিবাসীদের মধ্যে চরম উন্নতি করেছে যারা দুঃখ বলে কিছু অনুভব করতে পারেনি, তাদের আদিবাসী দলিত বলা যায় না। এই প্রসঙ্গে বলা যায় অধিকাংশ আদিবাসীই দলিত কিন্তু সব দলিত আদিবাসী নয়। আদিবাসী সমপ্রদায়ের মধ্যে বহু সমপ্রদায় আছে। মোট সমপ্রদায় ১৮২টি আদিবাসী। প্রত্যেক সমপ্রদায় তার নিজস্ব ভাষা প্রথা, সংস্কৃতি, নিয়ম-কানুন, ঐতিহ্য ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত হয়।

এক্ষনে আমরা গবেষণা করে দেখি আদিবাসী সমপ্রদায়ের মধ্যে রবিদাস সমপ্রদায় পড়ে কিনা? আমরা জানি আদিবাসী সমপ্রদায় হতে হলে তাকে কয়েকটি বিষয়ের ওপর তার নিজস্ব সত্তা থাকতে হবে। যেমন_

১. তার নিজস্ব ভাষা ২. তার নিজস্ব কৃষ্টি কালচার ৩. তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক রূপ ৪. ধর্মীয় আচার-আচরণ ও রীতিনীতি। ৫. তারা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করে।

১. রবিদাসদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারা নাগরি ভাষায় কথা বলে। ২. রবিদাসদের জন্ম এবং মৃত্যুতে ঢোলক বাজিয়ে আনন্দ এবং শোক প্রকাশ করে। এই অনুষ্ঠানে তারা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে। ৩. রবিদাস সমপ্রদায় প্রকৃতির পুজারি। অর্থাৎ সূর্য পূজা বটগাছ পূজা ইত্যাদি করে থাকে। ৪. রবিদাস সমপ্রদায়ের নিজস্ব প্রথা আছে। যেমন বিয়ের অনুষ্ঠানে কোন ব্রাহ্মণ লাগে না। অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষের বর ও কনের পূর্ব পুরুষদের সাত সিঁড়ির নাম উচ্চারণ অন্তে বিয়ে সম্পন্ন করে। এর কোন লিখিত প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। ৫. রবিদাস সমপ্রদায়ের মধ্যে অন্যান্য আদিবাসী থেকে তার নিজস্ব সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন সাঁওতাল সমপ্রদায়ের সংস্কৃতি থেকে ওরাং সমপ্রদায়ের সংস্কৃতি পৃথক। আবার সাঁওতাল ও ওরাং সমপ্রদায় থেকে রবিদাস সমপ্রদায়ের সংস্কৃতি পৃথক। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। ৬। রবিদাস সমপ্রদায়ের ছেলে মেয়েরা দীর্ঘদিন থেকে আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া সম্পন্ন করছেন। যেমন অ্যাডভোকেট বাবুল রবিদাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আদিবাসী কোঠায় ভর্তি হয়ে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেছে। জয়পুরহাটের ছেলে সুজন রবিদাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করছে। জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক, চেয়ারম্যানরা রবিদাস সমপ্রদায়কে আদিবাসী হিসেবে সনদপত্র প্রদান করছেন।

৭. এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক বইটির সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মেজবাহ কামাল সাহেব। তিনি তার বইটিতে রবিদাস সমপ্রদায় আদিবাসী মর্মে উল্লেখ করেন, তাছাড়াও আদিবাসী লেখক বাবু মিথুশিলাক মুর্মু তাহার এক লেখাতে রবিদাস সমপ্রদায়কে বাংলাদেশের আদিবাসী মর্মে প্রকাশ করেছেন। ৮. রবিদাস সমপ্রদায় যে, আদিবাসী তাহার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো শ্রীমতি গোলাপী রানী রবিদাস, পিতা- শ্রী কানাই লাল রবিদাস, স্বামী- অজিত চন্দ্র রবিদাস সাং জালালপুর, উপজেলা- আক্কেলপুর, জেলা- জয়পুরহাট। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা মতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জয়পুরহাট জেলায় সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। মিস কেস নং ৩২(এ)/১৩।

আরও পরিলক্ষিত হয় যে, ৯৭ ধারা প্রথম অংশের বর্ণনার পর তথায় ‘যথা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই যথা শব্দের মানে কী? যথা শব্দের ইংরেজি শব্দ হলো ঊীধসঢ়ষব, বাংলা হলো উদাহরণস্বরূপ। কাজেই আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি ওই স্থলে উদাহরণস্বরূপ কিছু কিছু আদিবাসীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আরও সব আদিবাসী সমপ্রদায়ের নাম উক্ত স্থলে সংযুক্ত হবে মর্মে বুঝা যায়। যথা শব্দটি ব্যবহৃত হলে সব কিছু বুঝায় না, অনেক বাকি থেকে যায়। শুধু বুঝার জন্য কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শুধু কি রবিদাস সমপ্রদায়ের মানুষরা ঐতিহ্যগতভাবে চামড়া পাকা অন্তে জুতা প্রস্তুত করে থাকে? ঋষি সমপ্রদায়ের মানুষেরাও একই কাজ করে। তবে ঋষিরা আদিবাসী কেন হবে না? উত্তর হচ্ছে ঋষি সমপ্রদায়ের মানুষদের মধ্যে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি প্রথা পরিলক্ষিত হয় না এবং ঋষিরা বাংলা ভাষাভাষির লোক। তারা মূলত হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি বহন করে। তাই ঋষি সমপ্রদায় দলিত হতে পারে কিন্তু আদিবাসী হতে পারে না। তার মূল কারণ হলো মুসলিম সমপ্রদায়কেও আজ-কাল জুতা প্রস্তুত ও মেরামত করতে দেখা যায়। তাহলে কি মুসলিম সমপ্রদায়কে আদিবাসী বলব। কখনোই আদিবাসী বলব না। তবে জুতা প্রস্তুতকারীকে মুসলিম দলিত বলতে পারি। অর্থাৎ একই কাজ করলেই আদিবাসী বলা যায় না। যেমন বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অধিকাংশ আদিবাসী সমপ্রদায় কৃষি কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আবার মুসলিম, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ইত্যাদি ধর্মের মানুষেরাও কৃষি কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রশ্ন হলো- তাহলে কি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ধর্মের অনুসারীদের আমরা আদিবাসী বলব। কখনোই বলব না। তবে রবিদাস সমপ্রদায়কে আদিবাসী বলব।

উপসংহার : দলিত শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং উহা সীমাহীন। সেখানে সব ধরনের গরিব দুঃখী অসহায় বঞ্চিত নিপীড়িত নির্যাতিত ও পতিত হওয়া জাতিগুলো স্থান পায়। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এবং সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ। শুধু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ও ঘোষিত কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিজস্ব ভাষা-ভাষী ও সংস্কৃতি সম্পন্ন জনগোষ্ঠীই আদিবাসী সমপ্রদায় নামে পরিচিত হয়। প্রকৃত পক্ষে দলিত স্থানে- সব শ্রেণী সব সমপ্রদায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু আদিবাসীর স্থানে সব শ্রেণী সব সমপ্রদায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তবে আদিবাসী সমপ্রদায় দলিত শ্রেণীভুক্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নাগরিক উদ্যোগ কর্তৃক প্রকাশিত দলিত জনগোষ্ঠীর নামের তালিকায় সাঁওতাল, ওরাং, মুন্ডা, মাহাতো ইত্যাদি নাম দেখা যায়। সর্বোপরি উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, রবিদাস হচ্ছে আদিবাসী সমপ্রদায়ভুক্ত একটি জাতি।

Reference