আদিবাসী নাম-বিতর্ক

জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে সকালবেলা আদিবাসী নাম-বিতর্ক বিষয়ে লিখতে বসে প্রথমে মনে পড়ল কল্পনা চাকমাকে। ১৯৯৬ সালের এই মাসের ১২ তারিখে গভীর রাতে অপহূত এবং নিখোঁজ হওয়া হতভাগ্য এক পাহাড়ি মেয়ের নাম কল্পনা চাকমা। কী অপরাধ ছিল তাঁর? স্নাতকপড়ুয়া এই মেয়েটি ছিলেন ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’-এর একজন নেত্রী। তিনি নিজেদের অধিকারের কথা বলতেন, তর্ক করতেন, প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতেন। কল্পনার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে ঝড় তুলেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্বিগ্ন করেছিল। তাঁর নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটি কি আদৌ রিপোর্ট তৈরি করেছিল, না পরবর্তী সরকার সেটা ধামাচাপা দিয়েছিল, তা আর জানা যায়নি।
কবি জড়িতা চাকমার লেখা কল্পনা চাকমা কবিতাটি থেকে তিনটি পঙিক্তর উদ্ধৃতি দিয়ে নিখোঁজ মেয়েটিকে স্মরণ করা যাক: ‘স্বদেশ প্রেমের চিন্তা-চেতনায়/ নিপীড়িত নারীসমাজের প্রতিরোধ দুর্গ গড়েছ তুমি/ তাই লিখে যাব তোমাকে নিয়ে শতাব্দীকাল ধরে।’
মন্ত্রিপরিষদে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’-এর খসড়া বিল অনুমোদিত, ও পরে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বিলটি পাস হওয়ায় এখন তা আইনে পরিনত হয়েছে। বিলটিতে বাংলাদেশের আদিবাসীদের নতুন নামকরণ করা হয়েছে যে তারা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’। অর্থাৎ আইনটি কার্যকর হওয়ার ফলে এতকাল আদিবাসী নামে তাদের যে পরিচয় ছিল, সেটা আইনত বাতিল হয়ে গেল, এখন তাদের পরিচিতি হবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এই শব্দগুচ্ছটি কার কিংবা কাদের মস্তিষ্ক থেকে বের হয়েছে এবং কেন বের হয়েছে, সেটা মৌখিকভাবে জানতে পারলেও লিখিত সাক্ষ্য-সাবুদ এখনো না পাওয়ায় সে বিষয়ে এখন লিখছি না। তবে আসুন প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, বাংলা ভাষার অভিধান খুলে পড়াশোনা করা যাক। নৃ-শব্দটির অর্থ নর, মনুষ্য, মানুষ। শব্দটি বাংলা ভাষায় উপসর্গ হিসেবে ব্যবহূত হয়। যথা—নৃকপাল, অর্থ নরমুণ্ড কিংবা নৃকেশরী, অর্থ নরশ্রেষ্ঠ। ইংরেজি ভাষায় নৃ শব্দটির প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘অ্যানথ্রপ’ যথা—অ্যানথ্রপলোজি, অর্থ নৃতত্ত্ব; কিংবা অ্যানথ্রপইড, অর্থ নৃসদৃশ।
অতএব দেখা যাচ্ছে, নৃ-গোষ্ঠী শব্দগুচ্ছটির অর্থ হচ্ছে মানবগোষ্ঠী। যিনি কিংবা যাঁরা এই শব্দগুচ্ছটি তৈরি করেছেন, দেখা যাচ্ছে, তাঁর কিংবা তাঁদের মতে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা দুই ভাগে বিভক্ত—বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। সে ক্ষেত্রে আমি আর বাঙালি থাকছি না, আমিও হয়ে যাচ্ছি বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী।
নৃ-বিজ্ঞান পরিভাষা আদিবাসী শব্দটির এই সংজ্ঞা দেয়: ‘কোনো এলাকার প্রাচীন জনবসতি ও তাদের সংস্কৃতি বোঝাতে টার্ম বা পদটি ব্যবহূত হয়। আধুনিক জনগোষ্ঠীর জৈব সামাজিক প্রভাবজাত নয়, এমন জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলা হয়। পৃথিবীর সর্বত্রই কমবেশি আদিবাসী রয়েছে। সাধারণভাবে পার্বত্য এবং অরণ্য অঞ্চলে বসবাসকারী শতাব্দীর লালিত সংস্কৃৃতির ধারক-বাহকদের আদিবাসী বলা হয়। সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা সবচেয়ে আদিম জনগোষ্ঠী।’ এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তর-মধ্য ও উত্তর-দক্ষিণ অংশে লাল শক্ত মাটির ঢিবি ও পাহাড়ি অঞ্চলের নাগরিকদের আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা খুবই সহজ। বাংলাদেশের বরেন্দ্র অর্থাৎ সমতল অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাংশের নাগরিকদের মধ্যে অবাঙালি প্রাচীন জাতিগুলোকে আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করাও তেমনি সহজ হবে, যদি ইতিহাস থেকে সাক্ষ্য নেওয়া হয়। খুব বেশি দূরবর্তী সময়ের কথা নয়। বাংলাদেশের বরেন্দ্র ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অনাবাদি ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। এই অঞ্চলগুলোকে যারা বসতযোগ্য ও আবাদযোগ্য করেছে সেসব সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি জাতিগুলোই বাংলাদেশের সমতল আদিবাসী।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে বাগেরহাট জেলায় যে আদিবাসীদের বাস, তারা রাজবংশী জাতি। উত্তর বাংলা ও দক্ষিণ বাংলার আদিবাসীদের নামে তাদের স্বত্বদখলীয় জমির যে খতিয়ানগুলো ইংরেজ আমলে ও পরবর্তী সময়ে প্রস্তুত হয়েছিল, সেগুলোতে তার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। বস্তুত বাংলাদেশের আদিবাসীরা ৪৫টি পৃথক জাতিভুক্ত। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়া বাঙালি ও এসব আদিবাসী নরনারীর দেহমন মিলিয়েই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সত্তা। এই ভৌগোলিক ভাগ্যই যে আমাদের গর্ব, সেটাই উচ্চারিত হয় জাতীয় সংগীতে: ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আদিবাসী শব্দগুচ্ছটি পাওয়া যায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে—আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ‘ভূমি কমিশন’ গঠন করা হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ কর্তৃক ২০০৬ সালের ২৯ জুন ‘আদিবাসী জনগণের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হয়েছে।
ঘোষণাটিতে সর্বমোট ৪৬টি অনুচ্ছেদ আছে এবং অনেকগুলো অনুচ্ছেদের একাধিক দফা আছে। কয়েকটি অনুচ্ছেদের অনূদিত উদ্ধৃতি এই: ‘আদিবাসী জনগণের রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। এই অধিকারের বলেই তারা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করতে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে সক্ষম।’ (অনুচ্ছেদ-৩) ‘প্রত্যেক আদিবাসী জনগণের রয়েছে একটি জাতীয়তা অর্জনের অধিকার’ (অনুচ্ছেদ-৬)। ‘আদিবাসী জনগণের রয়েছে সেসব ভূমি, ভৌগোলিক এলাকা ও সম্পদসমূহের ওপর অধিকার, যা তারা ঐহিত্যগতভাবে অধিকার, দখল বা অন্যভাবে ব্যবহার অথবা অর্জন করে এসেছে’ (অনুচ্ছেদ ২৬, দফা ১)। ‘আদিবাসী জনগণের রযেছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐহিত্য এবং প্রথাসমূহ চর্চা ও পুনরুজ্জীবনের অধিকার।…’ (অনুচ্ছেদ ১১, দফা ১)
সম্ভবত জাতিসংঘের উপরিউক্ত ঘোষণাপত্রের তাগিদে প্রণীত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনটির শুরুতে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়’। আইনটির ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বলবৎ হইবার সঙ্গে সঙ্গে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে নিম্নবর্ণিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইবে।’
আইনটিতে উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেটা এই—নেত্রকোনা, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাজশাহী, মৌলভীবাজার ও অন্য যেকোনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান; অথচ বগুড়া জেলার একটি উল্লেখযোগ্য এলাকায় ওঁরাও আদিবাসী বাস করলেও উপরিউক্ত তালিকায় নির্দিষ্টভাবে বগুড়ার নাম উল্লেখ করা হয়নি। আইনটির তফসিলে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে, যা অশুদ্ধ এবং আদৌ তথ্যভিত্তিক নয়। যে কেউ এযাবৎকাল প্রকাশিত প্রবন্ধ ও বইগুলো পড়ে থাকলে তালিকাটি পড়ে বিরক্ত হবেন। কারণ আমরা প্রায় সবাই জানি, আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত জাতিগুলোর সংখ্যা কমপক্ষে ৪৫টি হবে।
সবচেয়ে আপত্তিজনক এবং দুঃখজনকও বটে, আদিবাসীদের নাম আইনটিতে বদলিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী করা। কিন্তু যিনি বা যাঁরা করেছেন, তিনি বা তাঁরা বামালসুদ্ধ ধরা পড়ে গেছেন। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অন্যায় কাজ করলে তার চিহ্ন কাজটির মধ্যেই ধরা পড়ে। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা লক্ষ করুন, আইনটির ২ ধারার ২ উপধারা, যার উদ্ধৃতি এই: ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ’।
এই উপধারাটি স্বীকার করছে আদিতেই ‘আদিবাসী’ ছিল, কিন্তু এখন তাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী করা হলো। আমার জন্ম রাজশাহী শহরে মাতামহীর বাড়িতে। রাজশাহীর সাঁওতাল আদিবাসীদের নেতা ছিলেন সাগারাম মাঝি। তিনি ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি রাজশাহী শহরের সাগরপাড়ায় আদিবাসীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯৫৪ সালেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি আদিবাসী ছাত্রাবাস। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ছাত্রাবাসটি দ্বিতল ভবন করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর সেটার নামকরণ হয় ‘সাগারাম মাঝি আদিবাসী ছাত্রাবাস’। এখন আলোচ্য আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর ওই ছাত্রাবাসের নেমপ্লেট ফেলে দিয়ে কি নতুন নেমপ্লেট বসাতে হবে, যাতে লেখা থাকবে ‘সাগারাম মাঝি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছাত্রাবাস’? কিন্তু যদি বলা হয়, আলোচ্য আইনটির আওতায় ছাত্রাবাস পড়বে না, তাহলেও রাজশাহীতে আলোচ্য আইনের আওতায় যে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে, তার নাম তো দিতেই হবে ‘রাজশাহী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’, তখন ছাত্রাবাসের নেমপ্লেট আর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নেমপ্লেট পড়ে কি হাততালি দেওয়া যাবে?
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

Reference