একাত্তরের মতো সংখ্যালঘু নির্যাতন চালাচ্ছে জামায়াত : প্রতিরোধের কর্মসূচি ঘোষণা সুশীল সমাজের

একাত্তরের মতোই ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে দেশজুড়ে তা-ব এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু হয়েছে। তাদের এই তা-ব একাত্তরের সহিংসতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় বলে মন্তব্য করেছেন দেশের সুশীল সমাজের নেতারা।
গতকাল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্রের সামপ্রদায়িক হামলাসহ সব সহিংস তৎপরতা রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা একথা বলেন।
মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্রের চলমান সামপ্রদায়িক হামলাসহ সব সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলনে সুশীল সমাজের প্রতিরোধ কর্মসূচিরও ঘোষণা দেয়া হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক এমএম আকাশ, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ডা. সারওয়ার আলী, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারেক আলী, সুশান্ত কুমার দাস, শামসুল হুদা, খুশী কবির প্রমুখ। এছাড়া ‘মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্রের সামপ্রদায়িক হামলাসহ সব সহিংস তৎপরতা রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’-এর পক্ষে সংহতি জানিয়েছেন অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমিন হক, কামাল লোহানী, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আয়েশা খানম, সৈয়ম শামসুল হক, শাহদীন মালিক, ড. আকবর আলি, ড. আবুল বারকাত, শাহীন আনাম, হারুন হাবিব, অজয় রায়, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বিনায়ক সেন, রাশেদা কে. চৌধুরী, আলী যাকের, অধ্যাপক আবদুল মান্নান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রমুখ।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সারাদেশে তা-ব শুরু হয়েছে। তাদের লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে তাদের মুক্তি। সারাদেশের মানুষ ‘৭১-এর বিচার চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জাগরণের সৃষ্টি করেছে কিন্তু তাদের ইসলামবিরোধী বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত এবং সারাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। ন্যক্কারজনকভাবে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর থেকে এই রায় প্রত্যাখ্যান করার নামে একটি মহল অতি পরিকল্পিত উপায়ে দেশকে নৈরাজ্য ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে সহিংস পথ বেছে নিয়েছে। এর পরিণতিতে ইতিমধ্যে ষাট জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং শত শত মানুষ আহত বা সংকটজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। নিহত এবং আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং নারী, শিশুসহ নিরীহ সাধারণ নাগরিক রয়েছেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে সন্ত্রাস বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চরম অরাজক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে যারা দেশকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে, তারা আসলে নতুনভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেরই বিরোধিতায় নেমেছে। তাদের এই তৎপরতা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধেরই শামিল।
তিনি আরও বলেন, আমরা তাদের এই অপতৎপরতা, বিশেষত সাধারণ নিরীহ নাগরিকদের ওপর আক্রমণ, হত্যা, পুলিশের ওপর সশস্ত্র হিংস্র আক্রমণ ও খুন এবং সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের মানুষের বাড়িঘরে একাত্তরের মতোই অগি্নসংযোগ, লুটপাট, হত্যা, তাদের মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয়ে আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
সুলতানা কামাল বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহিংস ও সশস্ত্র আক্রমণের পথ পরিহার করে প্রতিবাদ করার বিষয় থাকলে শান্তিপূর্ণ পথে তা জানানোর আহ্বান জানাচ্ছি। সরকার ও প্রধান বিরোধীদলসহ সব রাজনৈতিক দল যাতে তাদের কথা ও আচরণে যথেষ্ট সংযম ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন, সেটিই আশা করি। দেশের পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাধারণ মানুষ-নারী, শিশু, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীসহ সবার জানমালের নিরাপত্তা দিতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছি। ইতোমধ্যে সহিংস ঘটনায় সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ হতাহত হয়েছে, বাড়িঘরে আগুন লাগানো, লুটপাট, মসজিদ, মন্দির ভাঙার মতো ঘৃণ্য কাজ করা হয়েছে, জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়া হয়েছে, শহীদ মিনার ভাঙা হয়েছে_ ওইসব ঘটনার দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত এবং তদন্তের ভিত্তিতে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়ারও দাবি জানাচ্ছি।
পাশাপাশি দেশের এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং দেশে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় রাখতে চাই, তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই চক্রের সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে এবং স্ব-স্ব অবস্থান থেকে এদের কর্মকা-কে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধির উদ্যোগে আগামীকাল বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণমানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। ওই মানববন্ধনে অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
বর্তমানে যে সামপ্রদায়িক সহিংসতা চলছে এর বিষয়ে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সুলতানা কামাল বলেন, আগামীতে কর্মসূচির একটি অংশ হিসেবে এমন তদন্ত কমিটি গঠনের সম্ভাবনা আছে।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপস্থিত সবাই ঐকমত্য হন এই ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুশান্ত কুমার দাস বলেন, বর্তমান সময়ের হামলা ‘৭১-কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখন ওই সময়ের মতো সহিংস হামলা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা দেশকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে রয়েছে। তাই সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুললে এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব।
ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ১৯৬৪ সালের ভয়াবহ সামপ্রদায়িক দাঙ্গার সময় ইত্তেফাকের তৎকালীন সম্পাদক মানিক মিয়ার নেতৃত্বে প্রধান তিনটি দৈনিক সম্পাদকীয় করে ‘রুখে দাড়াঁও পূর্ববাংলা’ শিরোনামে, যা জনসাধারণের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে। আজও আমাদের সেভাবে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।

Reference