দলিত জনগোষ্টীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্তকরণে রাষ্ট্র ও আমাদের করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক

rajbari
দলিত জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে শারি সংস্থার আয়োজনে রাজবাড়ী জেলায় দলিত পঞ্চায়েত ফোরাম রাজবাড়ী জেলা কমিটি এবং শারি’র যৌথ আয়োজনে গত ২৪ জুলাই ২০১৭ ভিপিকেএ কেন্দ্রে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শারি’র উপ সমন্বয়কারী রঞ্জন বকসী নুপুর সঞ্চালনায় সকাল ১১ টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পলাশ চন্দ্র দাস, সভাপতি, দলিত পঞ্চায়েত ফোরাম, রাজবাড়ী জেলা কমিটি। প্রধান অতিথি ছিলেন ফকির আব্দুল জব্বার, চেয়াম্যান, রাজবাড়ী জেলা পরিষদ। সম্মানিত আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন খান মোঃ জহুরুল হক, সভাপতি, রাজবাড়ি প্রেসক্লাব, মাজহারুল ইসলাম, শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা, মোঃ ফেরদৌস শেখ, ক্রেডিট সুপারভাইজার, জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, লুৎফর রহমান লাবু, এনজিও সমন্বয়কারী, নির্বাহী পরিচালক, রাশ, রাজবাড়ী, হাফিজ আল আসাদ, নির্বাহী পরিচালক, ভিপিকেএ ফাউন্ডেশন এবং অধ্যাপক খায়রুল হাসান, নির্বাহী পরিচালক, ওয়েড।
শারি’র সমন্বয়কারী উমেশ সাহা স্বাগতিক বক্তব্য রাখেন উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানিয়ে এবং উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে শারি’র মানবাধিকার সুরক্ষা কার্যক্রমের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরেন। একই সাথে দলিত জনগোষ্ঠীর মূলধারায় সম্পৃক্তকরণে লবি, এডভোকেসি, র‌্যালি, মানববন্ধন, দিবস উদযাপন, মানবাধিকার সুরক্ষা কমিটি গঠন ও সচেতনতা মূলক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় সমূহ তুলে ধরেন। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারীগণ নিজ নিজ পরিচয় প্রদানের পর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দলিত ও মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস মিডিয়া ডিফেন্ডার ফোরামের সদস্য সোহেল রানা। মূল প্রবন্ধে সাংবিধানিক অধিকার, দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি বিশেষ প্রকল্প সহায়তা এবং সেফটিনেট এর আওতায় সহায়তা বিষয়ক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি বিষয়ে দলিত জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার দিকসমূহ প্রতিফলিত হয়েছে। দলিত জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করণে উপস্থিত সুধীবৃন্দের প্রতি আহবান রাখা হয়েছে যেন স্ব-স্ব কর্ম অবস্থান থেকে সকলেই আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে দলিত জনগোষ্ঠির মূল ধারায় সম্পৃক্ত করণে উদ্যোগী হতে পারেন।
বিশেষ অতিথি জেলার এনজিও সমন্বয়কারী লুৎফর রহমান লাবু বলেন, প্রবন্ধে সংবিধানের আলোকে মানবাধিকার বিষয় সমূহ আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের অনুসরনে সরকার সকল ব্যবস্থা এখনও গ্রহণ করেনি বা ঘোষণা দিয়ে থাকলেও বাস্তবতায় জনগণের প্রাপ্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গৃহীত হয় না। এখনও অনেক ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও সামাজিক বৈষম্য চলে আসছে। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের প্রতিপালক। সংবিধান অনুসরনে জনগণের আকাঙ্খা বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তাদেরকে স্ব স্ব দপ্তরের যে সকল সহযোগিতা ও সেবা রয়েছে তা দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য যতটা সম্ভব প্রাপ্তির জন্য আহŸান জানান।
দলিত জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উজ্জ্বল দাস, স্বপ্না দাস, ল²ী দাস, বিপ্লব দাস এবং কার্তিক কুমার দাস তাদের বক্তব্যে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, শিক্ষাবৃত্তি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা সহায়তা ইত্যাদি সহযোগিতা বিষয়ে অনুরোধ জানান এবং একই সাথে দাবিও করেন যেন এই সব সহায়তা দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য নিশ্চিত করা হয়।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ক্রেডিট সুপারভাইজার মোঃ ফেরদৌস শেখ বলেন, আমাদের এখানে ৫টি ট্রেডে প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে। এইচএসসি পাশ হলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ আছে। অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিতে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পাশ হতে হবে। তাছাড়াও রয়েছে ভিজিডি প্রোগ্রাম ও মাতৃত্বকালীন ভাতা। যোগাযোগই একমাত্র সুযোগ সৃষ্টি করে। আপনাদেরকে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে। আমার জানা মতে আপনারা কখনোই যোগাযোগ করেন না।
রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের সহ সম্পাদক, কালের কন্ঠ ও একুশে টেলিভিশনের রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কর্মদক্ষতা সৃষ্টি করা গেলে মানুষ দক্ষতার ব্যবহারে সুখী হতে পারে। যে সকল সরকারি সেবা কর্মসূচীর আওতায় দক্ষতা বিকাশের সুযোগ রয়েছে সে সকল দপ্তর সমূহকে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টির অনুরোধ জানাই। ভিপিকেএ নির্বাহী পরিচালক এমন উদ্যোগের জন্য শারি’কে বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানান। তিনি তাদের নিজস্ব কর্মসূচী সমূহে স্থানীয় দলিত জনগোষ্ঠীকে সেবা নিতে এগিয়ে আসার জন্য আহŸান জানান। একই সাথে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ জানান, যেন বাৎসরিক বাজেটে পিছিয়ে পড়াদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়।
শহর সমাজসেবা কেন্দ্রের কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, জীবনমান উন্নয়নে সমাজসেবা কেন্দ্রের ইতিমধ্যে প্রদেয় সহযোগিতা সমূহ তুলে ধরেন। বয়স্ক ভাতা পাচ্ছে ১০৬৩ জন যার মধ্যে দলিত জনগোষ্ঠী ৪৪ জন। বিধবা ভাতা পাচ্ছে ৭ জন ও প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে ১০ জন। ১৪৭ জন শিক্ষা বৃত্তি যার মধ্যে ১০ জন রয়েছে দলিত। বাগদী ও হরিজনদেরও ২জন করে ভাতা পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ন্যাশনাল সোস্যাল সেফটিনেট সিকিউরিটি বিষয়ে জানুন, দাবী করুন এবং আদায় করুন। আপনারা এগিয়ে না আসলে আপনাদেরকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য কখনওই কেউ এগিয়ে যাবেনা। কোন উপজেলায় সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে কে এখন কর্মরত আছেন তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে তিনি একটা স্বচ্ছ ধারনা দেন।
প্রধান অতিথি ফকির আব্দুল জব্বার (চেয়ারম্যান রাজবাড়ী জেলা পরিষদ) বলেন, দলিত জনগোষ্ঠী কোন কিছুতে এগিয়ে আসতে চায়না। চাকুরির জন্য ডাকা হলে আসতে চায়না বা এসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর দেখা করেনা। আমি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সহযোগিতা করার জন্য সকল সময়েই প্রস্তুত থাকি। যেমন গীর্জায় কেউ কখনও কোন সহযোগিতা দেয়নি ও নিতেও আসেনি। গীর্জার উন্নয়ন কাজের জন্য সহযোগিতা করা হয়েছে। উপস্থিত সকলকে আমি অনুরোধ করবো আপনারা কন্যা শিশুকে প্রাধান্য দিন এবং কন্যা শিশুর উন্নয়নে আমার পক্ষ থেকে সহযোগিতা সকল সময়েই থাকবে। উপস্থিত দলিত অংশগ্রহণকারীদের যারা কলেজে পড়েছে তাদেরকে দেখতে চান এবং শিক্ষাবৃত্তি পান কিনা জানতে চান। তারা কেউ পায়না বলে জানান। উপস্থিত ৬ জন শিক্ষার্থীকে চেয়ারম্যান বরাবরে অর্থ সহায়তা প্রপ্তির আবেদন করতে বলেন এবং প্রত্যেককে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।
পরিশেষে, সঞ্চালক শারি সংস্থার পক্ষ থেকে সকলকে আবার ধন্যবাদ জানান এবং সহযোগী আয়োজক সংস্থা সমন্বিত প্রমিলা মুক্তি প্রচেষ্টার পরিচালক জনাব মোকাররম হোসেনকে ধন্যবাদ প্রদানের আহবান জানান।
জনাব মোকাররম হোসেন আজকের এই আয়োজনকে স্মরণে রেখে নিজেদের উন্নয়ন ও কল্যাণে আরও বেশি উদ্যোগী হওয়ার জন্য দলিত অংশগ্রহণকারীদেরকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। উপস্থিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দকে অনুষ্ঠানকে সুন্দর ও সার্থক করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
সভাপতি পলাশ চন্দ্র দাস সমাপনী ভাষণে বলেন, আমরা অত্র এলাকার দলিত জনগোষ্ঠী শারি সংস্থার সহাযোগিতায় এবং মোকারম ভাইয়ের প্রচেষ্টায় সংগঠিত হয়েছি। শারি’র আয়োজনে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছি। অনেক কিছু জেনেও আমরা উদ্যোগী হয়ে উঠিনি, আজকের আলোচনায়, আপনাদের অনুপ্রেরনায় ও সহযোগিতার প্রতিশ্রæতি আমাদেরকে অনেক বেশি উজ্জীবিত করেছে। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় ও উৎসাহে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।