দলিত জনগোষ্ঠিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রণোদনা দেয়া জরুরি

সুব্রত দাস রনক :: দলিত জনগোষ্ঠিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রণোদনা দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। দলিত শব্দটি সামাজিকভাবে নিচু হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ওইসব পেশার সাথে যারা জড়িত তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তাই ‘দলিত’ বলতে বাংলাদেশে কাঠামোগতভাবে নির্যাতিত, বঞ্চিত, প্রান্তিক সেসব মানুষকে বোঝায় যারা শুচি-অশুচি বা অস্পৃশ্যতার ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পেশা, বংশ, জাতি বা দলগত পরিচয়ের কারণে বংশ পরম্পরায় বৈষম্যের শিকার। দলিতরা সাধারণভাবে শ্রেণী রাজনৈতিক প্রভাব এসব বিবেচনায় সবচেয়ে প্রান্তিক ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর একটি। কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ জেলার ৬টি উপজেলায় কর্মক্ষেত্রে দলিত জনগোষ্ঠী পিছিয়ে বলে উল্লেখ্য করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সাথী সমাজকল্যান সংস্থার উপদেষ্টা সিনিয়র শিক্ষক বাবু রতন চন্দ্র দাস। এ ক্ষেত্রেও সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা দরকার। তিনি বলেন, দলিত সম্প্রদায় ও তার প্রজন্মকে মানবসম্পদে পরিণত করা সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের অধিকাংশ বাঙালি মুসলিম হলেও এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে আবার যথেষ্ঠ বৈচিত্র্য রয়েছে। রয়েছে নানা জাতি-গোষ্ঠির বসবাস। তেমনি একটি বিশেষ সম্প্রদায় দলিত জনগোষ্ঠি। দলিত শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘দল’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ ‘ভগ্ন’। এটা সাধারণত নির্যাতিত, নিচু, বিচূর্ণ এসব অর্থে ইংরেজিতে ব্যবহার করা হয়। তারা চামড়ার কাজ, ঋষি, মুচি, কসাই, কলু, ধোপা, জেলে বা পরিচ্ছন্নতার কাজ করে থাকে। মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের চোরমর্দ্দন গ্রামের মৃত সুরেন্দ্র দাসের ছেলে হরেকৃষ্ণ দাস। বয়স প্রায় ৫৫ বছর। তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে পৈত্রিক পেশা চামড়ার কাজ করে আসছেন। তিনি যখন থেকে কাজ শিখেছেন তখন থেকেই তিনি ভ্রাম্যমান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, দলিত সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বংশ পরম্পরায় তারা চর্মকারের কাজ করে আসছেন। এক সময় এ পেশায় ভালো আয় উপার্জন হতো। প্রতিদিনকার আয়ে ভালই চলতো তাদের সংসার। বর্তমানে এ অবস্থা আর নেই। এখন যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। পৈত্রিক এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাবেন এ সুযোগ বা সামর্থ্যও তাদের নেই। তিনি মনে করেন হাঁস-মুরগী, গবাদীপশু পালনে দলিত নারীদের উৎসাহিত করা, দলিত পুরুষদের নিজ পেশাসহ বর্তমান পেশায় পূঁজি বিনিয়োগে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করা, কর্মক্ষেত্রে দলিত জনগোষ্ঠিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রণোদনা দেয়া খুবই জরুরী। একটি বড় অংশ আবার বাদ্য-বাজনার কর্মী হিসেবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করে। কেউ বাসায় বাসায় হেটে কাজ সংগ্রহ করেন। কেউবা আবার রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বসে কাজ করেন। জুতা সেলাই, জুতা পলিশ (রঙ) করাসহ নিত্য ব্যবহার্য্য ব্যাগের নষ্ট হয়ে যাওয়া চেইন মেরামত করে থাকেন। এতে তাদের যে আয় হয় তা দিয়ে কোনরকম প্রাণ বাঁচিয়ে চলা যায়। কিন্তু ভবিষ্যতে এভাবে চলা সম্ভব নয়। পৈত্রিক এ পেশা ধরে রাখতে দোকান নিয়ে ব্যবসা করার ইচ্ছা থাকলেও দোকান ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। এছাড়া দোকান ভাড়া নিতে হলে অনেক টাকা সিকিউরিটি দিতে হয়। দোকান সাজাতে ( ডেকোরেশান করতে) অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সে সামর্থ্য তাদের নেই। কোন ব্যাংক বা বানিজ্যিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ আনতে গেলেও কেউ তাদের ঋণ দিতে চায় না। এ অবস্থায় তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে বিকল্প উন্নয়ন ভাবনায় প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থাকরণ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কামনা করেন। সমাজের দলিত ঋষি সম্প্রদায়কে তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। তাদের শিক্ষিত করতে হবে। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দলিত জনগোষ্ঠীর বিকল্প উন্নয়ন ভাবনা তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে পরনির্ভরশীলতা কমে আসবে। ফলে তাদের জীবনমান উন্নত হবে। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে তাদের অধিকার আদায়ে আমাদের মাঠে নামতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দলিতদের চাকরি স্থায়ীকরণ, গৃহায়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ, তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ স্থায়ী বাসস্থানের জন্য খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার দাবি জানান তিনি।