দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবে বাগেরহাটের দলিত সম্প্রদায় ও দরিদ্র সংখ্যালঘুরা বাল্য বিয়ের কুফল জানেনা

index
আজাদুল হক, বাগেরহাট :: বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সরকারী ও বেসরকারীভাবে নানা কর্মসূচী করলেও বাগেরহাটের দলিত সম্প্রদায় ও দরিদ্র সংখ্যালঘুরা বিবাহ রেজিস্ট্রেশন ও বাল্য বিবাহের কুফল বিষয়ে কিছুই জানেনা। সরকারী বা বেসরকারী ভাবে এ কর্মসুচী বিষয়ে সভা সেমিনার হলেও প্রচার প্রচারনা না থাকা ও দলিত স¤প্রদায় এবং দরিদ্র সংখ্যলঘুরা এ সব সভা সেমিনারে অংশ নিতে পারে না। ফলে সরকারের এ পদক্ষেপটি প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে পারে নাই। এমনই কথা বললেন, বাগেরহাট জেলা সদরে কর্মরত একাধিক সংবাদকর্মী। সমাজের সব থেকে সুবিধা বঞ্চিত বাগেরহাট সদরের মুনিগঞ্জ ঋষিপাড়া এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে এ বিষয়ে জানতে গেলে ওই পাড়ার গৌর রবি দাস, দীপক রবি দাস ও তাদের স্ত্রীরা জানান, আমাদের মেয়েরা একটু বড় হলেই একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন করে থাকি। কত বছরে বিয়ের বয়স হয় বা ছোট থাকতে বিবাহ দিলে কি কি অসুবিধা হয় তা আমরা জানিনা। আমাদের পুরোহিত ডেকে বিবাহ সম্পন্ন করি। আর পুরোহিতও আমাদের বাল্য বিবাহ বিষয়ে কোন ধারণা দেন না। বিবাহ রেজিষ্টেশন বিষয়ে তাদের কোন কিছুই জানা নেই বলে তারা এ প্রতিবেদককে জানান। বাগেরহাট শহরের লিচু তলা এলাকার সুধির ডোম, শেখর হেলা ও রিপন ডোম বলেন, মেয়েরা বিবাহ যোগ্য হয়েছে কিনা তা তাদের মায়েরা বলে দেয়। পরে আমাদের মধ্যেই রিতিনীতি মেনে বিবাহ হয়। আমরা বিবাহ করেছি খুব অল্প বয়সেই। আইন-কানুন বিষয়ে আমাদের জানা নেই। জেলা হরিজন ঐক্য পরিষদ সভাপতি কার্ত্তিক লাল হেলা বলেন, আমাদের সম্প্রদায়ের পুুরুষরাই এখনও সামাজিক অবস্থানে যেতে পারছেনা। আমাদের মেয়েদের পরিবারের বাইরে কোন অবস্থান নাই। ফলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বিষয়তো দুরের কথা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়েই তারা কিছু জানেনা। জেলা দলিত পঞ্চায়েত ফোরামের সভাপতি সুকুমার রবিদাস বলেন, বাল্য বিবাহ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং আমাদের অধিকার বিষয়ে কোন জানা ছিলনা। সম্প্রতি বেসরকারী সংস্থা শারি’র মাধ্যমে আমরা প্রশিক্ষন পেয়েছি। এখন থেকে এসব বিষয়ে ঘরের মহিলারা ও আমরা সচেতন হবো। বেসরকারী সংস্থা খুলনার রূপান্তরের আমরাই পারি প্রকল্পের সমন্বয়কারী রিজিয়া পারভিন বলেন, রূপান্তর, ব্র্যাকসহ বেশ কয়েকটি এনজিও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগ, সুশিল সমাজ ও মিডিয়া পার্সনদের সাথে অনেক এ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম করা হয়। তবে দলিত সম্প্রদায়কে নিয়ে কোন প্রোগ্রাম করা হয়নি। ব্র্যাকের জেলা প্রতিনিধি মারুফ পারভেজ বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করাসহ দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করতে ব্র্যাক বেশ কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। দলিত সম্প্রদায় নিয়ে ব্র্যাকের কোন প্রকল্প নাই। নারী নেত্রী ও উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট পারভিন আহম্মেদ বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা যাবে না। যারা বাল্য বিবাহ দিচ্ছে এরা বাল্য বিবাহের কু-ফল জানেনা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষরা। এসব দলিত বা দরিদ্রদের সচেতন করে তুলতে হবে। তাহলে এমনিতেই বাল্য বিবাহ কমে যাবে। বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক এনজিও ইস্যুভিত্তিক কাজ না করে টেবিলমেট কর্মসূচী পালন করে সংস্থা টিকিয়ে রাখে। শারি নামের একটি এনজিও দলিত ও মাইনরিটিদের নিয়ে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কসপ করেছে। সেখানে আমি নিজেই বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করার কৌশল বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। দলিতরাও মানুষ, তাদেরও মানবাধিকার আছে। একটি বা দুটি সভা-সেমিনার করে দরিদ্র মানুষদের সচেতন করা যাবে না। টার্গেট নির্ধারন করে দলিত ও দরিদ্র মাইনরিটিদের প্রশিক্ষন দিতে হবে। তাই দলিতদের স্বাভাবিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতে এনজিওদের পাশাপাশি সকল স্তরের মানুষের ভুমিকা থাকতে হবে। দলিত মেয়েদের লেখা-পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলেই দলিত বা দরিদ্র সংখ্যালঘুদের পরিবারে বাল্য বিবাহ হবেনা।
আজাদুল হক, দৈনিক সংবাদের বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি এবং শারি’র দলিত এন্ড মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস মিডিয়া ডিফেন্ডার ফোরামের সদস্য।