দিনাজপুরে সংখ্যালঘুরাই শুধু নন সাংবাদিকরাও আতঙ্কে

গত ১ সেপ্টেম্বর প্রাচীনতম জাতীয় দৈনিক_ ‘সংবাদে’ দিনাজপুর চিরিরবন্দরসংক্রান্ত কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। চিরিরবন্দরের ঘটনা বলতে ওই উপজেলার বলাইবাজার গ্রামে বিগত ৪ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে, সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন ধর্মীয় মৌলবাদীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, সেই বিষয়ে তিনটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। দুটি সংবাদ হলো ওই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে গণঐক্য কমিটি ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে ৩১ আগস্ট তারিখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য বিষয়ক দ্বিতীয়টি একই ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে দিনাজপুর শহরে আয়োজিত সমাবেশ ও মানববন্ধনসংক্রান্ত। তৃতীয়টি হলো ওই ঘটনার অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং দায়ীদের নামধামসহ খবর দিনাজপুরের স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশের পরিণতিতে সেখানকার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মতো সাহসী সাংবাদিকতার কারণে সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলামকে মৌলবাদীরা নির্মমভাবে আঘাত করে এবং গুরুতর আহত অবস্থায় দিনাজপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য করা সংক্রান্ত খবর।
আমার বর্তমান নিবন্ধটি ‘দিনাজপুরে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় সাংবাদিক গুরুতর আহত শীর্ষক, ১ সেপ্টেম্বর দৈনিক ‘সংবাদ’ এর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় দুই কলামব্যাপী খবরকে কেন্দ্র করে লিখতে বসেছি। প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয় ‘দিনাজপুরে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত হয়েছেন দৈনিক করতোয়া এবং স্থানীয় দৈনিক প্রতিদিনের চিরিরবন্দর প্রতিনিধি মোর্শেদুল ইসলাম।
‘সাংবাদিক মোর্শেদুল ও তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, সম্প্রতি চিরিরবন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ ও লুটপাটের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা এ হামলা চালিয়েছে। হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলাকারীদের নামসহ এবং এসব হামলাকারীদের সঙ্গে চিরিরবন্দর থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টরের সংশ্লিষ্টতার বিষয় উল্লেখ করে, গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলাম একটি অনুসন্ধানমূলক সংবাদ প্রকাশ করেন।
এই ঘটনায় অভিযুক্তরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ইন্ধনে সাংবাদিক মোর্শেদুলকে বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদান করে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিরিরবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘুগড়াতলী মোড়ে প্রকাশ্যে দুষ্কৃতকারীরা মোর্শেদুলকে আটকিয়ে হামলা চালায়। দুষ্কৃতকারীরা ইট দিয়ে তার মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। দুষ্কৃতকারীরা সাংবাদিক মোর্শেদুলের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডারসহ হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর হামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণাদি নিয়ে পালিয়ে যায়।
বর্তমানে সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলাম ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দিনাজপুর প্রেসক্লাব, দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন ও দিনাজপুরে সাংবাদিক সমিতির নেতারা। দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি চিত্তঘোষ, সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবী দুলাল এবং দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আজাহারুল আজাদ জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাহী সদস্য কামরুল হুদা হেলাল ও রতন সিং এবং দিনাজপুর সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসানুল আলম সাথী পৃথক পৃথক বিবৃতিতে অবিলম্বে সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলামের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর হামলাকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান তারা।
দিনাজপুরের যে সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল তারা কেউই আজ আর বেঁচে নেই। বর্তমানে যারা সেখানে সাংবাদিকতা করছেন তারা বয়সে অনেক তরুণ তাই সবাই আমার অপরিচিত। আমিও তাদের কাছে অপরিচিত। হয়তো কেউ কেউ নামে চিনতে পারেন ব্যস ওই পর্যন্তই। সাক্ষাৎ পরিচয় কারও সঙ্গেই নেই, হওয়ার সুযোগও ঘটেনি। তবুও তাদের উত্থাপিত ওই দাবিগুলোর সঙ্গে আন্তরিক সংহতি প্রকাশ করছি। প্রচ- বেদনা বোধ করছি। সত্য খবর অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে দু-দুটি পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলামকে নির্মমভাবে প্রহার করে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য করা হলো। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, একদল দুষ্কৃতকারী চিরিরবন্দরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রকাশ্য সহযোগিতা করেছিল, পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তার ইঙ্গিতে। এ পর্যন্ত, থানায় মকদ্দমা দায়ের করা সত্ত্বেও, মোর্শেদুলকে আঘাত করার অভিযোগে কাউকেই গ্রেফতার করার খবর জানা যায়নি। এর অর্থই হলো কাউকে গ্রেফতার করা বা গ্রেফতারের চেষ্টাও করা হয়নি। ওই থানার পুলিশ তো ওই ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী এবং তারা সবাই নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। তাই যে জামায়াতে ইসলামীর ক্যাডারদের দ্বারা ওই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটানো হলো তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যককেই এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের সিংহভাগকেই জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। মুক্তি পেয়ে তারা আবার নতুন করে হুমকি দিচ্ছে ওখানকার সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু বাসিন্দাদের মামলা তুলে নেয়ার জন্য। এ খবরও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তবুও তাদের জামিন বাতিল করা হচ্ছে না বা গ্রেফতার করে কারারুদ্ধও করা হচ্ছে না। উপরন্তু এই সত্য খবর প্রকাশের দায়ে সাংবাদিক আক্রান্ত হচ্ছে এক কথায় চিরিরবন্দরে এক ত্রাসের রাজত্বই কায়েম করা হয়েছে। যার একটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য হলো ওই এলাকাকে হিন্দুশূন্য করা এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশত্যাগে বাধ্য করা। চিরিরবন্দরের প্রশাসনও জামায়াতে ইসলামীর এহেন মতলব কার্যকর করার ষড়যন্ত্রে সহযোগী বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন তো প্রকাশ্যেই তা করছে। সংশ্লিষ্ট ইউএনও ওই তা-ব সংঘটিত করার পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছেন। তাকে বদলি করা হয়েছে কিন্তু কেন তিনি গ্রেফতার হবেন না? কেন তিনি মামলার আসামি হবেন না তা বোধগম্য নয়। ওখানকার জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান আমির প্রত্যক্ষ উসকানিদাতা, মসজিদের ইমামও তাই। কিন্তু তারা দিব্যি প্রকাশ্যে নিরাপদে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিন্দুমাত্র আড়াল-আবডালে থাকারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন না। আর তা করবেনই বা কেন? করার তো আদৌ প্রয়োজনীয়তা নেই।
কারণ, প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সেখানকার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ঘটনার পরদিন ওই এলাকায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের ভাঙাচুড়া বাড়িঘর দেখেন, গৃহচ্যুতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। ঘটনার জন্য দায়ী কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না বলে ধর্মীয় সংখালঘুদের আশ্বস্ত করেন বটে কিন্তু অতঃপর আর কোন খোঁজখবর নেই প্রায় এক মাস অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও। জানা যায়, তিনিও ভিতরে ভিতরে জামায়াতে ইসলামী যাতে বিপদে না পড়ে সে ব্যাপারেই নাকি অধিক তৎপর। এ কারণেই সেখানকার ইউএনওর বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের হয়নি, হবে এমনটা কেউ মনেও করতে পারছেন না। তাহলে সবটা যোগ করলে কী দাঁড়ায়? জামায়াতের নেতাকর্মীরা যারা প্রকাশ্যে ঘটনা ঘটাল, যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইউএনও প্রকাশ্য মদতদাতা সেই প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারিদলের এমপি সবাই যেন একাট্টা। ভাবখানা যেন এই যা হওয়ার হয়ে গেছে, ব্যাপারগুলো দুঃখজনক, সবাই এখন হাতে হাত মিলিয়ে চলাই তো ভালো। মামলা-মকদ্দমার মাধ্যমে হয়তো কিছু লোককে জেলখাটানো যাবে কিন্তু তাতে রেষারেষিই বাড়বে এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে না।
কিন্তু তাই কি? অপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনকালেই কি শান্তি ফিরে এসেছে। শান্তি তখনই আনতে পারে যখন সব অপরাধীরা এবং সহযোগীরা ও মদতদাতারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবেন তখন। তখনই কেবল লোকে বুঝবে আইনের চোখে হিন্দু-মুসলমানে কোন বৈষম্য নেই বরং তা সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সমাজের মনে আস্থার ভাব ফিরে আসবে অপরাধীরা বুঝতে সক্ষম হবে যে অপরাধ করলে আইন তাদের রেহাই দেবে না। দুঃখজনক যে, মুখে আমরা যতই আইনের শাসনের কথা বলি, গণতন্ত্রের কথা বলি, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি, কাজে যে আমরা তা নই, বারবার প্রমাণিত হচ্ছে এই নৃশংস হামলাগুলোর মধ্যে দিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বা আপস করে কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের শাসন বা গণতন্ত্র যে আদৌ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না তা তো সেই ১৯৭১ সালেই তারা তা দেখিয়ে দিয়েছে। তবুও আমরা যেন তাদের সম্পর্কে আজও কোন শিক্ষা নিতে নারাজ। তাই জামায়াতে ইসলামীকে বৈধ দল হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিই সংবিধান সংশোধন করে, একইভাবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং আরও অসংখ্যভাবে। প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে করে, এসবের পরিণতিতে কষ্টে হলেও হিন্দুরা না হয় দেশত্যাগ করে জানে বাঁচল কিন্তু প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানরা কি তখন এ দেশে থাকতে পারবেন। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর দেশগুলো কী শিক্ষা দেয়?
আমরা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতার কথা বলি। চিরিরবন্দরের সাংবাদিক মোর্শেদুল ইসলামকে নির্মমভাবে মেরে মারাত্মকভাবে আহত করা এবং তা সত্ত্বেও অপরাধীদের গ্রেফতার না করা তা প্রমাণ করে?

Reference