প্রবাসীর চোখে স্বদেশ মিসিং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, দায়িত্ব কার?

অজয় দাশগুপ্ত
সম্প্রতি দেশের বহুল জনপ্রিয় প্রিন্ট মিডিয়া প্রথম আলোয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্রুত সংখ্যা হ্রাসের একটি খবর বেরিয়েছে, বিগত কয়েক বছরে লাখ খানেক হিন্দু জনগোষ্ঠী মিসিং, এই খবরটি ছেপে তারা জনমনে যে প্রশ্ন বা ভাবনার সলতে উসকে দিয়েছে তা জরুরি হলেও নতুন কিছু নয়। এই যে সংখ্যাতত্ত্ব এখানেও ফাঁকি আছে। আমাদের দেশে কোন পরিসংখ্যান বা সংখ্যাই সঠিক বলে ধরে নেয়া যায় না। এটাতো আদমশুমারি বা মাথা গোনার কাজ। অর্থ, টাকা পয়সা, ব্যাংকের হিসাবের মতো জরুরি ব্যাপারেও আমাদের দেশের সংখ্যাতত্ত্ব নির্ভুল কিছু নয়। এখন কারিগরি উৎকর্ষ, প্রযুক্তি ও তথ্যায়নের সুফলে অনেক কিছু সহজ হয়ে উঠেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর বা সংখ্যা পাওয়াটা এখন কঠিন নয়, ফলে ধামাচাপা দেয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো কাজ করে না। তবে উল্লসিত কিংবা উৎফুল্ল হওয়ার মতো জায়গায়ও পেঁৗছিনি আমরা। যে কারণে এই সংখ্যা সঠিক এমন মনে করার কারণ নেই, এর কম বেশি হতেই পারে, তবে এটা ঠিক, এই যে মিসিং বা হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী এরা কোথায়, কীভাবে, কেন হারিয়ে গেছে আমরা সবাই জানি, রাজনীতি জানে, অর্থনীতি জানে, সমাজও জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এদের থাকা না থাকায় লাভ ক্ষতির পাল্লা যে দিকে ঝোঁকে মুক্তিযুদ্ধের সেই রাজনীতিও এ বিষয়ে হয় উদাসীন নতুবা নিস্পৃহ। অথচ যে সংগ্রাম ও যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার প্রতিপক্ষ কারণ হিসেবে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদার্থক ভূমিকা চিহ্নিত করতে ভুল করেনি। পাকিস্তানি গবেষণা, পাক মন্তব্য ও রাজাকারদের দৃষ্টিভঙ্গি এ বিষয়ে পরিষ্কার। তারা গোড়া থেকেই বলে আসছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি থেকে বিজয় অবদি সব প্রক্রিয়াতেই হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের প্রভাব রয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে হিন্দু শিক্ষকম-লী ও আওয়ামী লীগই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বা মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য শক্তি। তাদের এই বিশ্লেষণ ভুল কিছু নয়। শত্রু পক্ষ ঘটনাবলির বিশ্লেষণে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতকে প্রাধান্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে, আওয়ামী লীগ ও হিন্দু বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে এক সূত্রে গ্রন্থিত করা, এর ভেতর উভয়ের দায়িত্ববোধ বা সম্পর্কের ব্যাপারটাও জড়িয়ে। যারা মনে করেন হিন্দু বা সংখ্যালঘুরা জন্মগতভাবে, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নৌকাপন্থি বা আওয়ামী ভোটার তারা আসলে ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’। যে কোন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সে দেশের মূলধারা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও আধুনিকতার সঙ্গে চলতে ভালোবাসে। এটাই স্বাভাবিক। কোন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠী সেকেন্ড ক্লাস কিংবা থার্ড ক্লাস হয়ে বাঁচতে চায় না। কারও করুণা, দয়া বা লাঠির জোরে তথাকথিত নিরাপদ বসবাসও তাদের কাম্য নয়। বাংলাদেশের বেলায় তার ব্যতিক্রম হবে কোন দুঃখে?
লেখাটি লেখার সময় জিন বিজ্ঞানী অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কৃতী বাঙালি আবেদ চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে, আবেদ ভাই সজ্জন মানুষ। কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে তিনি স্নেহ করেন, ভালোবাসেন, তার এই অযাচিত ভালোবাসায় ঋদ্ধ হই আমি, সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম বাহন ফেসবুকে আমার সঙ্গে তার অনিয়মিতভাবে নিয়মিত কথাবার্তা হয়। এমনই এক যোগাযোগ তিনি মরিশাসের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলেন। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো আবেদ ভাই ভারত মহাসাগরে দ্বীপ রাষ্ট্র মরিশাসের কৃষি খাত নিয়ে কাজ করেন। সে দেশের মন্ত্রিপর্যায়েও তার অবারিত যোগাযোগ। বলছিলেন মরিশাসের উন্নয়নে সে দেশের সংখ্যালঘু ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অবদানের কথা, উজ্জীবিত আবেদ ভাই দেশে ফিরে বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের অবদান ও তারা কী করতে পারেন বা পারবেন এ নিয়ে গবেষণামূলক বই লেখার কথাও জানিয়েছিলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস আস্থা রাখলে, সুযোগ দিলে, রাষ্ট্র ও সমাজ পাশে দাঁড়িয়ে বৈষম্য দূর করলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা দেশের অবস্থা পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
আশায় বুক বাঁধলেও আমি কিছু বলতে সাহস পাইনি। সামান্য একটি লেখা ছাপা হলে কম্পিউটারের কল্যাণে ই কাগজের মন্তব্য পড়ে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। পান থেকে চুন খসলেই পার্শ্ববর্তী দেশের দালাল, চর বা দেশদ্রোহী বলে গাল দেয়ার কী প্রবল আগ্রহ, না আছে বিশ্বাস না উদারতা, কোন এক অজ্ঞাত কারণে হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের অবিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পৃক্ত না করার অলিখিত রীতি এখনও দূর হয়ে যায়নি। অতি সম্প্রতি একই দলের দুই মন্ত্রীর কেলেঙ্কারিতেও আমরা এর প্রতিফলন দেখেছি। আবুল হোসেনকে কেউ দেশ ছেড়ে ভেগে যেতে বলেননি। কেউ তার কুকীর্তির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশ বা অন্য দেশের নাম জড়িয়ে গালাগাল করেননি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও একই অপরাধে অপরাধী, অথচ তার বেলায় বিষয়টি ব্যক্তির গ-ি ছাড়িয়ে ধর্মীয় পরিচয় ও ভারত বিদ্বেষের হাতিয়ারে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল একদল মানুষ, সুরঞ্জিত বাবুর অপরাধ নিন্দনীয়, তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে তিনি দ-িত হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ঢালাও অবিশ্বাস সে জনগোষ্ঠীর জন্য নিশ্চয়ই ভীতিকর। এরপর তারা দেশ ছেড়ে পালাবেন বা নীরবে দেশত্যাগ করবেন এটা কি অস্বাভাবিক?
উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর রাজনীতি নিস্তেজ ও শক্তিহীন হয়ে আসলেও মরে যায়নি। মরে যায়নি বলেই দেশের আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মূর্তি ভাঙচুর, সম্পত্তি দখল, দেয়াল ভাঙার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ বা বর্তমান সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক। টপ লেভেলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র বা দেশ চাওয়াটাও সত্য বলে মানি, কেন না এ না হলে তাদের ক্ষমতা ও টলটলায়মান, কিন্তু এক সূত্রে বেঁধে দেয়া শত্রু কর্তৃক এক রজুতে বেঁধে রাখা সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ একত্রে চলে না, সেখানেও অবিশ্বাস আর সন্দেহ, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধাশ্রয়ী রাজনীতি এদের নিরাপত্তা ও আস্থা জোগাতে ব্যর্থ না হলেও দোদুল্যমান।
অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশটি ঘরের কাছে সহজগম্য হওয়ায় দায়িত্ব, ভুলে টাকা পাচার ও সম্পত্তি ক্রয়ে বেপরোয়া হিন্দুরাও দেশের ক্ষতি করে চলেছেন অহরহ। দেশের খেয়ে ওই দেশের কোষাগার স্ফীত করা বা গুণগান গেয়ে নীরবে দেশ ছেড়ে যাওয়া কাপুরুষতা। সেই ভীরুতাই আজকের সংখ্যাতত্ত্বে লাখ লাখ সংখ্যালঘুকে মিসিং বা দেশ ছাড়া দেখাচ্ছে। শুধু কি এরা? এইতো এই লেখাটি লেখার সময়ও পাহাড়ে ১৪৪ ধারা চলছে। এত বছর পরও পাহাড়ি-বাঙালি সমস্যার সমাধান হয়নি।
কোন উন্নত বা আধুনিক দেশ তার জনগোষ্ঠীর একাংশকে দূরে রেখে এগোতে পারে না। অন্যদিকে পলায়নপর জনগোষ্ঠীর জানা উচিত অন্যদেশে ভিক্ষাবৃত্তি বা উদ্বাস্তু হওয়াও সমাধান নয়। পথ একটাই সহাবস্থান। রাজনীতিই তা দিতে পারে। আশার কথা আজকাল তরুণ-তরুণীরা বিবাহবন্ধন সামাজিক বন্ধুত্ব আদর্শের সাহস ও আধুনিকতার আশীর্বাদে এসব সমস্যার ঊধর্ে্ব উঠছে। এরাই শেষ ভরসা। রাজনীতি ও রাষ্ট্র সহায়ক হলে এদেশ সুফিবাদ ও আধ্যাত্মবাদের কল্যাণে ধর্মীয় সম্প্রীতির আদর্শে পরিণত হতে পারবে। সে প্রমাণ অতীতে আছে, এখনও আছে। প্রয়োজন সুরক্ষা। রাষ্ট্র কি তা করবে?

Reference