বারবার কেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই আক্রান্ত হবেন?

সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। পেশাদার আর্মি-মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই সিভিল সমাজের মানুষও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল।

একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭১ সালে আমরা সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের সমর্থন পেয়েছিলাম। যদি আমাদের যুদ্ধ গণযুদ্ধ না হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ হতো তাহলে আমরা বিশ্ববিবেকের সমর্থন পেতাম না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালি নেতাদের নেতৃত্বে। ইতিহাসের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হলো, আমাদের বাঙালি নেতারা শত চেষ্টা করেও পাকিস্তানকে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপ দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একটি গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ, জাতি রাষ্ট্র গঠন করার জন্য আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।

এই স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে সবচেয়ে বড় মূল্য দিয়েছেন এদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকরা। পাকিস্তানি শাসকরা যেহেতু বিশ্বাস ও আদর্শগতভাবে সামপ্রদায়িক ছিলেন, হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন, তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, আগুন দেয়া লুটপাটের মতো নির্যাতন চালালেও বিশেষ আক্রোশের দৃষ্টিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছে হিন্দুদের। তাদের দৃষ্টিতে হিন্দু, কমিউনিস্ট, আওয়ামী লীগার সমান অপরাধে অপরাধী ছিল। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ নামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে পাক সেনাদের হিন্দু বিদ্বেষী চিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি ছিলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭২ সাল থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানপন্থিরা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধে তীব্র অপপ্রচার চালিয়েছে। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুটপাটের সঙ্গে যুক্ত রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী যারা সাধারণ ক্ষমা পাননি তারা ছাড়া অন্য রাজাকাররা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা লাভ করে কারাগার থেকে বের হয়ে ক্ষমাপ্রাপ্ত রাজাকাররাও স্বাধীনতার ম্যান্ডেটবিরোধী উগ্র সামপ্রদায়িক প্রচারণা চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার নূ্যনতম মূল্যও তারা দেয়নি।

একথা ওপেন সিক্রেট যে, বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে বিষাক্ত অপপ্রচার চালাত। হিন্দু সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে বিরামহীন বিদ্বেষ প্রচারে লিপ্ত ছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশে ঘাপটি মারা পাকিস্তান প্রেমিকরা একটা নতুন মাত্রায় হিন্দু নাগরিক বিদ্বেষী সামপ্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী নাগরিকদের মানসিক দিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছিল। তখন জামায়াতিদের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও বঙ্গবন্ধুকে কোণঠাসা করার প্রয়োজনে কয়েকটি রাজনৈতিক দল হিন্দু বিদ্বেষী রাজনীতি চাঙ্গা করে তুলেছিল। ক্রমাগত হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের মনে আছে তখন গোপনে একদল উগ্রপন্থি ‘মুসলিম বাংলা’ গঠনের প্রচারণায় নেমেছিল, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী।

এই গোপন প্রস্তুতি খোলাখুলি সংহার মূর্তি ধারণ করল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। দ্বিজাতি তত্ত্ব সবল হয়ে দাঁড়াল, পাকিস্তান আমলের মতো কোণঠাসা হয়ে অনেক হিন্দুই দেশ ছাড়া হয়েছিল। দেশের রাজনীতি, সংবিধান, প্রশাসনিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ সামপ্রদায়িক অবস্থানে রূপান্তরিত হয়েছিল। ২০০১ সালেও হিন্দু নাগরিকরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেননি। তারা দেশ ছাড়া হয়েছে। ভারতের বাবরি মসজিদের গোলমালকে কেন্দ্র করে এরশাদের আমলে এদেশে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর-দোকানপাট-মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে, তছনছ করা হয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ও পরে যা হয়েছে, তা ১৯৭১ সালকে হার মানিয়েছিল। তখন দেশের হিন্দু নাগরিকরা নির্যাতিত হয়েছেন, দেশান্তরী হয়েছেন। নারী ধর্ষণ তো হয়েছেই, বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় যত মন্দির আছে সেখানে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে।

এই সরকারের আমলেও ইন্টারনেট হ্যাক করে অপপ্রচার ছড়িয়ে কক্সবাজার, রামু, উখিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মঠ-মন্দির ধ্বংস করেছে। কারা করেছে এসব? এখন যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অচল করে দেয়ার জন্য সামপ্রদায়িক তা-বে নেমেছে, তারা করেছে।

গত চার মাস ধরে লক্ষ্য করা হচ্ছে যে জামায়াত-শিবিরের উগ্রপন্থিরা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পুলিশ হতাহত করেছে, দোকানপাট ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে, গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। গত ১ মার্চ শুক্রবার বিরোধীদলীয় নেত্রী সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার পরদিন থেকে তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা চালিয়ে সবকিছু তছনছ করেছে, প্রতিমা ভাঙচুর করেছে।

একটি জাতীয় পত্রিকার খবরের শিরোনাম ‘নোয়াখালীতে জামায়াত-শিবিরের তা-বে নিঃস্ব ৭৬ হিন্দু পরিবার’। নোয়াখালীর রাজগঞ্জ ইউনিয়নের ও আলাদীনগর গ্রামে জামায়াত-শিবিরের তা-বে ৭৬টি হিন্দু পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের আহাজারিতে পুরো এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। শুক্রবার অনেকে না খেয়ে রয়েছে। বৃহস্পতিবার সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণার পর ওই এলাকার ১০টি বাড়ি, ৩৬টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ সময় ৫৩টি ঘরে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। বাতাসে এখনও পোড়া গন্ধ আসছে। আতঙ্ক কাটেনি এখনও। (যায়যায় দিন- ০২-০৩-১৩)।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। পাশাপাশি জামায়াত-শিবির ও সামপ্রদায়িক গোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষার জন্য হিন্দুদের বাড়ি, সব ধরনের উপাসনালয় পাহারা দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে প্রজন্ম চত্বর থেকে। শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, সামপ্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা করবেন না। সবাই মিলে তা প্রতিহত করব। সবাই এক হয়ে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে ডা. ইমরান বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া হতাশাজনক সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দিয়েছেন। নির্লজ্জভাবে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনা ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। (জনকণ্ঠ-০৩-০৩-১৩)।

ডা. ইমরান একটা ঐতিহাসিক তথ্য দিয়েছেন তা হলো, জামায়াত ‘৪৭-এর আগে থেকে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

কেন জামায়াতি, দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাসীরা হিন্দু-বৌদ্ধ নাগরিকদের আক্রমণ করে? মৌলবাদীরা নারীদের যেমন ঘরে ঢুকিয়ে, পায়ে শেকল পরিয়ে খাঁচার পাখি বানাতে চায়, তেমনি হিন্দু বৌদ্ধ বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের দেশের ২য় শ্রেণীর পোষা নাগরিকে পরিণত করতে চায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থটা তারা সামপ্রদায়িক পন্থায় হাসিল করতে চায়। এরই বলি হচ্ছে হিন্দু বা বৌদ্ধরা বারবার। এর অবসান হওয়া উচিত।

Reference