ময়মনসিংহের দলিত সমাজ ব্যবস্থায় নেই নারী নেতৃত্ব, নেই সিদ্ধান্ত দেয়ার কোন সুযোগ

mymensingh dalit pic-2
আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ :: বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে আজ মধ্যম আয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বর্তমান সরকার প্রধান নারী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী, এমনকি জাতীয় সংসদের স্পিকারও হলেন নারী। নারীদের এতো জয়জয়কার অবস্থার মধ্যেও আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের এখনও অবহেলার দৃস্টিতে দেখা হয়। আমাদের মতো নারীদের নেই নেতৃত্ব দেয়ার কোন সুযোগ। প্রায় দুইশ’ বছর ধরে এভাবে চলছে নারীদের দমিয়ে রাখার পায়তারা। ক্ষোভের সাথেই এসব কথা বলছিলেন ময়মনসিংহ হরিজন পল­ীর গৃহবধু মুন্নী সরকার। তিনি হরিজন জনগোষ্ঠীর সদস্য হয়েও লেখাপড়া শিখে বর্তমানে হরিজন পল­ী কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। দুইশ’ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হরিজন পল্লীর ৩১ সদস্য বিশিষ্ট পঞ্চায়েত কমিটিতে নারীদের কোন অংশগ্রহণ নেই। নেই নারীদের নেতৃত্বের সুযোগ। তিনি আরও বলেন, এখানকার নারীরা আজ লেখাপড়া শিখছে, পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে এবং সংসারের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু নারীদের কিভাবে দমিয়ে রাখা যায় এ ব্যাপারে সব পুরুষরাই একজোট। তবে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সময় এসেছে এখন নারীদের নেতৃত্ব দেয়ার। তিনি পঞ্চায়েত কমিটিতে নারীদের নেতৃত্বে অংশ গ্রহণের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে এগিয়ে আসার আহবাণ জানান।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সারা দেশের মতো ময়মনসিংহেও দলিত সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বর্ণ বা গোত্রের মানুষ রয়েছে। এদের মধ্যে হরিজন, রবিদাস, বাশফোর, বেদে, সান্দার, ঋষি, শীল, রামবারী, কানপুরি, ডোমার, পশ্চিমা ইত্যাদি সম্প্রদায়ের নাম উলে­খ করা যায়। দলিতদের মধ্যে হরিজন, বেদে ও সান্দার সম্প্রদায়ের নারীরা সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমী। সান্দার সম্প্রদায়ের নারীরা গ্রামে গ্রামে বা নগরে নগরে ফেরী করে নানা প্রকার গৃহস্থালী জিনিষ যেমন থালা-বাসন, কাপ-পিরিচ, চামিচ, গ্লাস, মহিলাদের নানা ধরনের কসমেটিকস ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে। বেদে সম্প্রদায়ের নারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাপের খেলা দেখায়, শরীরে বিষব্যথা ও বাত রোগের চিকিৎসা করে, ঝাড়-ফোঁক দেয়, শিঙ্গা লাগায় এবং চাহিদা মাফিক অর্থ আদায় করে নেয়। এরা সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। হরিজন সম্প্রদায়ের পুরুষদের মতো নারীরাও পরিচ্ছন্ন কর্মীর কাজ করে থাকে। সমাজকে দূষণমুক্ত করে হরিজন নারীরা। এসব কাজের পাশাপাশি তারা সংসারের কাজও করে থাকে।
ময়মনসিংহ হরিজন পল্লীর পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য রাজা সিংহ শর্মা জানান, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনও অবহেলিত। ইচ্ছা করলেই তারা স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারেনা। তিনি আরও জানান, আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা নেতৃত্ব কিংবা মত প্রকাশের সুযোগ পায় না। তবে তিনি নারীদের নেতৃত্বে এনে পুরনো ধ্যান ধারনা বদলানোর দাবি করেছেন। তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোল গেলে তারা অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত হবে এবং নিজেরা সচেতন হবে। রাজা শিং শর্মা আরও জানান, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে যোগ্যতার ভিত্তিত্বে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সব শ্রেণী পেশার নারীকে সম-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে নারীর মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
হরিজন পল্লীর তারা রানী হরিজন জানান, দলিত সম্প্রদায়ের মাঝে এমন কিছু সম্প্রদায় রয়েছে যে সম্প্রদায়ের নারীরা ঘর গৃহস্থালীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্য কোন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এদেরকেও উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। হরিজন পল্লীর হরিজন ও বাশফোড় নারীদের অনেকেই শিক্ষার আল্য়ো আলোকিত হয়ে জীবনকে বদলানোর চেষ্টা করছেন। এরমধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখি কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।
হরিজন পল্লীর পঞ্চায়েত কমিটির উপদেষ্টা সদস্য আনার হরিজন জানান, দলিত জনগোষ্ঠীর নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে সংসারের অভাবের কারণে তাদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করেনা। প্রাইমারী লেখাপড়া শেষ করার পর অধিকাংশই ঝড়ে পরে। তিনি আরও বলেন, নারী নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য আগে নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। আনার হরিজন আগামী যে কোন সভায় পঞ্চায়েত কমিটিতে নারীদের অন্তর্র্ভূক্ত করার প্রস্তাব করার কথা জানান।
হরিজন পল্লীর রিপন কুমার দাস বলেন, এখানকার নারীদের মধ্যে কোন নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। এজন্য তারা পরিবার, সংসার এমনকি সামাজিকভাবেও কোন কর্মকান্ডে সিদ্ধান্ত দিতে পারেনা। তবে পঞ্চায়েত কমিটিতে নারী নেতৃত্ব আনা গেলে অবশ্যই নারীরা নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে এবং যে কোন সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নিতে পারবে।
হরিজন পল্লীর পঞ্চায়েত কমিটির সেক্রেটারী বিজয় চৌধুরী জানান, দুইশ’ বছর ধরে বাপ দাদার তৈরি করা নিয়মেই পঞ্চায়েতের কার্যক্রম চলে আসছে। আমাদের সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে নারীদের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু পঞ্চায়েতে এ ধরণের সুযোগ না থাকায় তাদের কমিটিতে রাখা সম্ভব হয়না। তবে তিনি নানা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এবং হরিজন পল্লীর এমন কিছু ঘটনা বা বিচার আচার করতে হয় যা নারীদের নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করা যায় না। সেখানে শুধু পুরুষরাই সেই দায়িত্ব পালন করতে পারে। এজন্য কমিটিতে নারীদের অন্তর্ভূক্তির সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীরা সব কিছুতেই এগিয়ে আছে, তাই তাদেরকেও কমিটিতে রাখা উচিত।
স্থানীয়দের দাবি, দলিত জনগোষ্ঠীর নারীদের মাঝে নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় কিংবা দাতের সেই সুযোগ না থাকায় তারা বহিযোর্গাযোগ কার্যক্রমে অশ নিতে পারে না।
দেশের এগিয়ে চলার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে দলিত নারীদের নেতৃত্বে আনতে হবে। তাদের শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান, অধিকার এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরী মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি, একুশে টেলিভিশন ও শারি’র হিউম্যান রাইটস মিডিয়া ডিফেন্ডার।