যশোরের হরিজন ও ঋষি পল্লীতে বাল্যবিয়েই প্রথা !

index
এইচ আর তুহিন, যশোর :: ১০-১৪ বছরের মধ্যে বিয়ে না হলে সেই মেয়ের কপালে জোটে ‘আইবুড়ো’ তকমা। আর ১৫ পেরুলে তো পাত্র পাওয়াই দুস্কর! ‘এতো বয়সী’ (১৫ বছর) মেয়েকে বিয়ে করবে কে ? আর কেউ রাজি হলেও বিনিময়ে দিতে হয় মোটা অঙ্কের যৌতুক। যে কারণে যৌবনে পদার্পণ করার আগেই বালিকাদের কাঁধে চেপে বসে সংসারের জোয়াল।
যশোরের বিভিন্ন হরিজন ও ঋষিপল্লীতে বাল্যবিয়ের এ রীতি আজও প্রচলিত। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কোনো সচেতনতা কার্যক্রমই এ জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রাচীন জীবনধারা থেকে বের করতে পারেনি।
সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ঋষিপল্লীর পুস্পর (৩৭) বিয়ে হয়েছিল ১০ বছর বয়সে। গর্বিত ভঙ্গিতে তিনি জানালেন, তার ১৮ বছর বয়সের ছেলের জন্য ১৩ বছর বয়সী বউ এনেছেন। তিনি জানান, ‘আমার ছুঁড়িকে (মেয়ে) বিয়ে দিয়েছি ১২ বছর বয়সেই’। ওই গ্রামের প্রায় সব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের একই রীতিতে বিয়ে হচ্ছে।
শহরের পৌরসভা হরিজন পল্লীতে ১৫-১৬ জন ‘আইবুড়ো’র বদনাম বয়ে বেড়াচ্ছে। নাম গোপন রাখার শর্তে ওই পল্লীর দু’জন বাসিন্দা জানান, ১৫ বছর পার হওয়ায় ওই মেয়েদের পরিবার বর খুঁজে পাচ্ছে না। সমাজে তাদের নিয়ে চলে কানাঘুষা। এ পল্লীর নীলমনি হরিজন জানান, তারও বিয়ে হয়েছিল মাত্র ৯ বছর বয়সে। তার চার ছেলে-মেয়ে। তাদের সম্প্রদায়ের মেয়েদের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়ার রীতি। ওই সময়ের মধ্যে মেয়ের বিয়ে না দিলে পিতার ‘অমঙ্গল’ হয়। অভাব-অনটনের কারণে যদি কোনো মেয়ের বয়স ১৬ পার হয়ে যায়, তা হলে তার আর বিয়ে হয় না। আজীবন সে পরিবারে বোঝা হয়ে থাকে। আরবপুরের চাঁনমনি ঋষির বিয়ে হয়েছে প্রায় বছর। তিনি জানান, চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার আগেই বাবা-মা তার বিয়ে দেন। স্কুল যেতে মন চায়, কিন্তু তাদের সামাজিক নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। অধিকাংশ মেয়েদের নাবালক বয়সেই বিয়ে হয়। বিয়ের পরই কন্যা শিশুরা মা হচ্ছে। এতে তাদের শরীর ভেঙে যায়। অন্যদিকে অপরিপক্ক শিশু জন্ম দিয়ে পরিবারকেও নানা সমস্যায় ফেলছে। শিশুরাও নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। অনেক শিশু মারাও যায়। এ ব্যাপারে মেডিকেল অফিসার ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রেবেকা সুলতানা দীপা বলেন, ‘উপযুক্ত বয়সের আগেই বিয়ে ও সন্তান ধারন করা হলে মা রক্ত শূন্যতাসহ নানা জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগবে। শিশুও হবে রোগাক্রান্ত’। এছাড়াও ওই মায়েরা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করতে পারছে না। ফলে অস্ত্রপচার করে তারা সন্তান জন্ম দিচ্ছে। বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) যশোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সূর্য্য বিশ্বাস জানান, শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ায় এ যুগেও দলিতরা সেকালের ধ্যানধারনা নিয়ে বেঁচে আছে। অল্পবয়সেই বিয়ে শাদি ও নানা কুসংস্কার লালন করছে তারা। তিনি আরও জানান, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশনে দলিত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নেই। তারা এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে না। প্রশাসনিক নিয়ম কানুন কেউ কেউ জানলেও তা মানা হয় না।
এইচ আর তুহিন, সহ-সম্পাদক, দৈনিক স্পন্দন ও যশোর প্রতিনিধি প্রতিদিনের সংবাদ এবং শারি’র দলিত এন্ড মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস মিডিয়া ডিফেন্ডার ফোরামের সদস্য।