রামু-পটিয়ায় বৌদ্ধমন্দিরে সাম্প্রদায়িক হামলা

জেলা বার্তা পরিবেশক, কক্সবাজার
ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরীফের অবমাননামূলক ছবি প্রকাশ করার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গতকাল কক্সবাজারের রামু-উখিয়া চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। উখিয়ার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এতে ৭ জন আহত হয়। উচ্ছৃঙ্খল জনতা শনিবার মধ্যরাতে রামু উপজেলার বিভিন্নস্থানে বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে হামলা চালায় ও অগি্নসংযোগ করে। হামলায় ১৩টি ছোট বড় মন্দির ও ২০টির বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও আগুনে পুড়ে যায়। পটিয়ায় গতকাল দুপুরে ৪টি মন্দির ভাঙচুর করে।
ভাঙচুর করা হয়েছে আরও দুটি বৌদ্ধ মন্দির এবং শতাধিক বসতঘর। এ ঘটনার পর কক্সবাজারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসন পুরো এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ এলাকায় টহল দিচ্ছে। গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক থেকে এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবিলম্বে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দেন। তবে স্থানীয় অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধ মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। ঘটনা তদন্তের জন্য এক সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে এ রিপোর্ট লেখাকালীন সময় পর্যন্ত রামুর পরিস্থিতি শান্ত ছিল।
সরেজমিন এলাকা পরিদর্শন ও স্থানীয় জনসাধারণ সূত্রে জানা গেছে, রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যুবক উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক একাউন্টে খুলে পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবি প্রকাশ করা হয়। একদল লোক ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননা করা হয়েছে এমন খবর বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে প্রচার করে। একই সময় একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ফেসবুক থেকে উলি্লখিত ছবিটি ফটোকপি করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়। এরপরই রামু ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে জনগণের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা রাতে বিভিন্নভাগে ভাগ হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মিছিল করে। এক পর্যায়ে তারা রামু উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা চালায় এবং অগি্নসংযোগ করতে শুরু করে। রাত প্রায় ১০টা থেকে শুরু হওয়া এ বিক্ষোভ মিছিল ও তা-ব প্রায় সারা রাত চলে।
স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অভিযোগ এ ঘটনায় রামু উপজেলায় ১৩টি ছোট বড় বৌদ্ধমন্দির ও ২০টিরও বেশি বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে আরও দুটি বৌদ্ধমন্দির এবং শতাধিক বসতঘর। উল্লেখ্য, এ ঘটনায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তি যা দেশের আদি ঐতিহ্য বহন করত তা ভস্মীভূত হয়েছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মন্দিরগুলো হচ্ছে- পশ্চিম মেরংলোয়া গ্রামের কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, উত্তর শ্রীকুল গ্রামের সাদা চিং ও লাল চিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ বৌদ্ধবিহার, উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার, সীমা ঘর, লাল চিং, বিমুক্তি ভাবনা বিদর্শন কেন্দ্র, উখিয়ারঘোনা গ্রামের তেজবন বিহার ও লট উখিয়ারঘোনা গ্রামের আর্য বংশ বৌদ্ধ বিহার। ভাঙচুর করা হয়েছে, চেরাংঘাটা বড় ক্যাং ও উত্তর ফতেখাঁরকুল গ্রামের বিবেকারাম বৌদ্ধ বিহার। অগি্নকা-ে পুড়ে যাওয়া বসতঘর ও দোকান মালিকদের মধ্যে কয়েকজন হল- অতিন্দ্র বড়ুয়া, ফকির ড্রাইভার, জুনু বড়ুয়া, অতিমোহন বড়ুয়া, তাফুরু বড়ুয়া, অঞ্জলী বড়ুয়া, জুনু বড়ুয়া (২), ফুরুক বড়ুয়া, তোফান বড়ুয়া, নিকাশ বড়ুয়া, শশি বালা বড়ুয়া, জুনু বড়ুয়ার দোকান, আব্বুলু বড়ুয়া, নিরঞ্জন বড়ুয়া প্রমুখ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রোববার ভোর থেকে রামুতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ধর্মীয় স্থাপনায় সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় রামুতে সর্বত্র চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। উল্লেখ্য, স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ_ ফেসবুকের এ ঘটনাটি নিয়ে সেখানে সন্ধ্যা থেকে নানা আলোচনা সমালোচনা চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টিকে আমলে নেয়নি। এমনকি উত্তেজিত শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন, অগি্নসংযোগ ও ভাঙচুর করার শুরুতেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ঘটনার রাতে মিছিল-সমাবেশ চলাকালে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা চালান, রামু-কক্সবাজার আসনের সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। তিনি উত্তেজিত জনতার উদ্দেশে বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। কেউ দোষ করলে তাকেই শাস্তি পেতে হবে। তাই বলে অন্যের ওপর হামলা বা ক্ষতি করা যাবে না।
রাত তিনটায় ঘটনাস্থলে আসেন, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী, পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তারা ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও বসতঘর পরিদর্শন করেন। রাত দেড়টায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য ও বিজিবি এবং রাত ২টায় সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়।
ঘটনার পর থেকে উখিয়াসহ জেলার বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আবাসস্থলগুলোতে পুলিশ, র‌্যাব টহল দিচ্ছে। তবে ওইসব এলাকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না ভয়ে। ছেলেমেয়েরাও গতকাল স্কুলে যায়নি।
গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, পুলিশের আইজিপি হাসান মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সিরাজুল হক খানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরে রামু চৌমুহনী স্টেশন চত্বরে এক সংক্ষিপ্ত সভায় মন্ত্রীদ্বয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
স্থানীয় অধিবাসীরা এই ঘটনার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগসাজশের অভিযোগ তুলেছে। কারণ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা বলে পরিচিত রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ও বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুরসংখ্যক লোক এসে রামুর এ সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে যোগ দেয় বলে জানা যায়। এছাড়া স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা এ ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। তাদের মতে কোন ঘটনায় স্থানীয় লোকজন হঠাৎ করে উত্তেজিত হলে সাধারণত কিছু ভাঙচুর, ইট, পাটকেল ছোড়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটে থাকে। এভাবে বিভিন্ন স্থানে বিভক্ত হয়ে দুর্বৃত্তরা অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ইত্যাদি চালাতে পারে না যদি পূর্বপরিকল্পনা না থাকে।
ইতোমধ্যে উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গতকাল ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, উখিয়ার কোটবাজারে দুপুরে এবং বিকেলে দু’দফা বৌদ্ধমন্দিরে হামলার এবং ৩/৪টি বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় মন্দিরে উপাসনার কাজে নিয়োজিত ভিক্ষুরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। দুপুরে পরিস্থিতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও বিকেলের ঘটনায় পুলিশকে গুলিবর্ষণ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের গুলিতে ৭ জন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছে। তন্মধ্যে ২ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলো ছিদ্দিক এবং গিয়াস উদ্দিন। তাদেরকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। রাত প্রায় ৮টায় হাসপাতাল সূত্রে জানায়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাই তাদের সদর হাসপাতালে প্রেরণের কথা ছিল। উল্লেখ্য, উখিয়ার প্রায় ৩২টি বৌদ্ধ মন্দিরে পুলিশ মোতায়েন এবং র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ অপ্পেলা রাজু নাহা।
পটিয়া(চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের লাখেরা গ্রামের বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের লাখেরা অভয় বৌদ্ধ বিহার, রত্নপুর বৌদ্ধ বিহার, শিব মন্দির, শ্রী দুর্গা মন্দিরে গতকাল দুপুরে ভাঙচুর ও লুটপাটে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে মেরিন শিপ ইয়ার্ড একাডেমির ৫ শতাধিক শ্রমিক ও স্থানীয় কিছু দুষকৃতকারী । এ সময় শ্রমিকরা হাতে লোহার রড, লাঠিসোটা নিয়ে একসঙ্গে ৪টি মন্দিরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এ ঘটনায় হিন্দু-বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনার খবর পেয়ে প্রশাসনের উচ্চ মহলের লোকজন দ্রত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার লাখেরা অভয় বৌদ্ধ বিহারে মেরিন শিপ ইয়ার্ডের ৫ শতাধিক শ্রমিক ও স্থানীয় একটি স্বার্থান্বেষী মহল ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হামলা চালিয়ে ৩৬টি পিতলের মূর্তি, ৬টি স্বর্ণের মূর্তি ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ, ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট, নগদ টাকা পয়সা, উপাসনার বিভিন্ন সরঞ্জামসহ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে বলে জানিয়েছেন লাখেরা অভয় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ধর্মান্নাদ ভান্তে ও মন্দির কমিটির সদস্য উৎপল বডুয়া। কোলাগাঁও শ্রী দুর্গামন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করে দানবাক্স থেকে নগদ ৪৩ হাজার টাকা নিয়ে অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে মন্দিরের সভাপতি বিপ্লব চৌধুরী জানিয়েছেন। এ সময় ১০ জন আহত হন, আহতদের মধ্যে সংঘ প্রিয় সমন (৭৫), ভাবান্নদ সমন (৫৫), সুভান্নদ (১৬), অজিত পালসহ (৩০) অনেকে।
এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ সুপার (পটিয়া সার্কেল) নজরুল ইসলাম বলেন, রামুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পটিয়ায় ঘটনাটি ঘটেছে । এখনও মামলা হয়নি। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
পরে পটিয়ার সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ ইদ্রিস মিয়া, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকেয়া পারভিন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান তিমির বরণ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা. দীলিপ ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার দে, সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার শ্যামল দে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়েছে । এদের গ্রেফতার করে শাস্তির দাবি জানান।

Reference