শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন নয় দলিত জনগোষ্ঠী

অচিন্ত্য মজুমদার :: দলিত পরিবারের অভিভাবকদের শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকে জানেই না শিশুর পুষ্টি কী জিনিস। জানেন না পুষ্টিকর খাবার কেন খায় এবং পুষ্টিকর খাবার কোনগুলো? ফলে দলিত জনগোষ্ঠির শিশুর শারীরিক উন্নতি হয় না। অধিকাংশ শিশুরাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এর প্রধান কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে দায়ি করেছে ভোলা পৌরসভার হরিজন কলোনীর বাসিন্দারা। তারা যেহেতু চিরস্থায়ী দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকেন সেহেতু স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। হাট-বাজার, রাস্তা, ড্রেন, টয়লেট, অফিস-আদালত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন তারা। কিন্তু তাদের জীবনটা পরিস্কার করতে কোনদিন সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেয়নি বলে জানান তারা। সরেজমিনে হরিজন কলোনীর বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে এমনসব তথ্য।

ভোলা শহর থেকে কিছুটা ভেতরে গেলেই পৌরবাপ্তা এলাকায় হরিজন কলোনী। এখানে ১০০ পরিবারের প্রায় সাড়ে ৬০০ দলিত জনগোষ্ঠির মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। এই ১০০ পরিবারের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ১২টি পরিবারের মা-বাবা স্বল্প শিক্ষায় শিক্ষিত। বাকিরা নিজের নাম হয়তো লিখতে পারে। কাজ শেষে নিজেদের কলোনীতে থাকেন তারা। বাইরে বিচরণ কম হওয়ায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে এদের জ্ঞান নেই বললেই চলে। ফলে সঠিক পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে গর্ভবতী মায়ের পেট থেকে তার সন্তান পুষ্টিহীনতায় ভোগা শুরু করে। যার প্রভাব পড়ে শিশুর শৈশব থেকে শুরু করে শিক্ষা ও কর্ম জীবনে। খুব সহজেই রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় তারা। এছাড়া সাধারণ একটি শিশুর যেমন স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশ ঘটে, দলিত শিশুদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে সাধারণ শিশুদের যে মেধার বিকাশ ঘটে, দলিত শিশুদের ক্ষেত্রে তা হয় না। ফলে শিক্ষাজীবন থেকে তারা খুব অল্পতেই ঝরে পড়ে। এতে করে দু’ইয়ের অধিক সন্তান জন্ম দেয় এসব পরিবারগুলো। দারিদ্র্য আর নিয়ন্ত্রনহীন সন্তান জন্মদানের কারণে শিশুদের প্রতি বাড়তি যতœ নেয়ার সুযোগ নেই এদের।

বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠির অধিকার আন্দোলন ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মানিক লাল ডোম জানান, জেলার ৭টি উপজেলায় প্রায় প্রতিটিতেই রয়েছে দলিত জনগোষ্ঠির বসবাস। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলিত জনগোষ্ঠির পরিবারের পুরুষ ও নারীরা বেশির ভাগই অজ্ঞ। দারিদ্র্য আর শিক্ষার আলো না থাকায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কী তাদের মধ্যে ধারণা নেই। ফলে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য যে পুষ্টিকর খাবার দিতে হয় তা না দিয়ে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্কদের মত খাবার খাওয়ানো হয়। মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শেষ হলে নিজেদের মতো ডাল-ভাত আর মাছ খাওয়ানো হয় শিশুদের। ডিম, দুধ, মাংসসহ পুষ্টিকর যে সকল খাদ্য শিশুর প্রয়োজন তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। মূলত মায়ের গর্ভ থেকে দলিত শিশুদের পুষ্টিহীনতা শুরু হয়। গর্ভকালীন মায়ের পরিচর্যা অথবা জন্মের পর শিশুর পরিচর্যা কী করে করতে হয় এর পরামর্শের জন্য ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে যান না দলিত জনগোষ্ঠির মানুষ। এমনকি শিশুদের পুষ্টিসহ রোগব্যাধির খবর জানতে তাদের কাছে সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে কোনো লোক আসে না।

দলিত জনোগোষ্ঠী সবদিক থেকে পিছিয়েপড়া বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। জীবনে চলার পথে প্রয়োজনীয় জ্ঞান তাদের নেই। ফলে দলিত জনগোষ্ঠীর বাবা-মা ও পরিবারের অন্যরা নিজেদের স্বাস্থ্য এবং শিশুদের পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন না। তাই স্বাস্থ্য-সচেতনতা বাড়াতে দলিত জনগোষ্ঠির প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন এই জনগোষ্ঠির মানুষ।

দলিত জনগোষ্ঠী প্রচলিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত বলে স্বীকার করলেন ভোলার সিভিল সার্জন রথীন্দ্র নাথ মজুমদার। তিনি বলেন, দলিত জনগোষ্ঠিকে স্বাস্থ্য-সচেতন করাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারন সমাজের এক শ্রেণীকে বাদ দিয়ে একটা জাতি উপরে উঠতে পারে না। তাই এই বিষয়টাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দলিত জনগোষ্ঠিকে মূলধারায় নিয়ে আসতে আমরা সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করবো। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসচেতনতা বাড়াতে চলতি মাসে মা ও শ্বাশুড়িদের নিয়ে ভোলায় ৫৬৮ টি উঠান বৈঠক করা হবে। এর মধ্যে ১২ টি উঠান বৈঠক করা হবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী অথবা দলিত জনগোষ্ঠির মা-শাশুড়িদের নিয়ে। উঠান বৈঠকে দলিতশ্রেণীর কেউ যেন বাদ না পড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয়ার কথাও বলেন তিনি।

ভোলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি দৌলত, খান খাদ্য গোডাউনের খাদ্য পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা শান্তি রঞ্জন দাস বলেন, শিশু যখন জন্ম নেয় তখন বাবা-মা এবং পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আর চিন্তাভাবনা শুরু করে। শিশুকে কী খাবার দিলে সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে। কী খাওয়াবে, কতটুকু খাওয়াবে এই চিন্তা প্রত্যেকেই করে থাকেন। কিন্তু সমাজে পিছিয়েপড়া দলিত জনগোষ্ঠির সঠিক জ্ঞানের অভাবে শিশুদের প্রয়োজনীয় খাবার দেয় না। এতে করে শিশুদের পুষ্টি ঘাটতি দেখা দেয়। তাই সবার আগে দলিত পরিবারের মা-বাবাকে শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতন করতে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে এলে এই পুষ্টি সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।