একটু স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপদে বসবাস করার স্বপ্নেও বিভোর ছিলেন দলিত মুক্তিযোদ্ধাগণ

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার মিরনজিললা (হরিজন কলোনী) সিটি কলোনীর শহীদগণ

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার মিরনজিললা (হরিজন কলোনী) সিটি কলোনীর শহীদগণ


ইভা পাল, উপ-প্রকল্প সমন্বয়কারী :: মা, মাটি ও মাতৃভূমি এই তিনটি শব্দ যেন মিশে আছে ধনী, দরিদ্র সকল বাঙ্গালীর প্রাণে। আর এই তিনটি শব্দকে কেন্দ্র করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন ভূমিকা রেখে গেছে লাখো প্রাণ। আর এই লাখো শহীদের ভিড়ে রয়ে গেছে অনেক জানা-অজানা দলিত প্রাণের কথা। এই অজানা কথা রয়েছে শারি সংস্থার Promoting Gender Sensitive Panchayets of Dalit Community in Bangladesh ৫০টি প্রকল্প (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও কেরাণীগঞ্জ) এলাকার মধ্যে ১০টি এলাকার ২৫জন মুক্তিযুদ্ধার কথা জানা যায়। যারা কিনা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে, স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন।
ঢাকার আনন্দনগর ঋষিপাড়ার ৬৫ (বর্তমান) বছরের নিপেন্দ্র চন্দ্র দাস (পিতা মৃত রমেশ দাস, মাতা রাশি রানী), ৬৮বছরের (বর্তমান) অনুকুল চন্দ্র দাস (পিতা মৃত পূন্য চন্দ্র দাস, মাতা মৃত রাধা রানী) সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় এবং অস্ত্র রাখার জন্য মাটির গর্ত তৈরী করতেন।
বেরাইদ টেকপাড়ার ৯০(বর্তমান)বছরের মনিন্দ্র চন্দ্র দাস মনা (পিতা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র দাস, মাতা-উষা রানী) বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে নৌকা পারাপারের কাজ করেছিলেন। অকপটে স্বীকার করেন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আমি সর্বদা কলমা পড়তাম এবং মাথায় টুপি দিতাম।
একই রকম ভাবে কেরাণীগঞ্জের পানগাঁও ঋষিপাড়ার ৬০ (বর্তমান)বছরের রাজকুমার দাস (পিতা মৃত অখিল দাস, মাতা মৃত বাদলী রানী), কালিগঞ্জ ঋষিপাড়ার ৬৮ (বর্তমান) বছরের ভরত দাস (পিতা মৃত তেলক্ষণ দাস), পারগেন্ডারিয়ার অগেন্দ্র দাস, মনা দাস এবং উত্তর রামেরকান্দার ৭০ (বর্তমান) বছরের চন্দ্র কিশোর (পিতা মৃত মাখন লাল মাতা মৃত মিলনী রানী) স্ব স্ব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের শুকনো খাবার সরবরাহের কাজ করতেন।
চিত্তরঞ্জন দাস, ঝিগাতলা ঋষিপাড়া

চিত্তরঞ্জন দাস, ঝিগাতলা ঋষিপাড়া


কথা হয় কেরাণীগঞ্জ উপজেলার তেঘুরিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডে বাঘৈর ঋষিপাড়ার সšতান ৫৩ বছরের (বর্তমান) নিরেন দাস (পিতা মৃত নরেন্দ্র দাস, মা-মৃত সেবা দাসী) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ততটুকু না বুঝলেও ৮বছরের কৈশোর বুঝে ছিল এটা বিজয়ের জন্য লড়ে যাওয়া তাই তাকেও কিছু করতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে যারা লুকিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তাদেরকে পানি খাওয়াতে, কখনও বা গ্রাম থেকে শুকনো খাবার (চিড়া, মুড়ি, গুড় ইত্যাদি) সংগ্রহ করে দিতেন। ঢাকার ঝিগাতলা ঋষিপাড়ার ৫৭বছরের (বর্তমান) চিত্তরঞ্জন দাস ১৯৭১ সালে ১২ বছরের কিশোর বিক্রমপুরের মরিচা গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র তৈরীর জন্য মাটি খুড়ে গর্ত করে দিতো। হয়তো তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না কিন্তু প্রাণে ছিল স্বাধীনতার গান। তাই প্রাণপনে জীবন বাজি রেখে লড়েছিল এই সবুজ সুন্দর জন্মভূমিতে স্বাচ্ছন্দে নিরাপদে বসবাস করার স্বপ্নে। আজ দেশ স্বাধীন। স্বাচ্ছন্দে বা নিরাপদে বসবাস করতে পারছে কিনা প্রশ্ন থাকলেও খোলা আকাশ পানে তাকিয়ে দুচোখ ভরে লাল সূর্যটাকে প্রতিনিয়ত দেখার সৌভাগ্য আছে এই বীর পুরুষদের। কিন্তু ঘরে ফেরা হলো না যাদের, যারা স্বাধীনতার সুখ উপভোগ করতে পারেননি এমন কিছু দলিত মুক্তিযোদ্ধা হলেন ঢাকার মিরনজিললা (হরিজন কলোনী) সিটি কলোনীর শহীদ ব্যক্তিবর্গ মাহাবীর লাল সামুন্দ, আনোয়ার লাল, নান্দু লাল, ঈশ্বর লাল, ঘাসিটা লাল, খালবাল, রামচরণ, নান্দা লাল, লাললু হেলা এবং শংকর হেলা ২২ নভেম্বর ১৯৭১ সাল রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মহলা থেকে ডেকে নিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছিল।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিতাই দাসের স্ত্রী হাসি রানী দাস

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিতাই দাসের স্ত্রী হাসি রানী দাস


একই রকম ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সহায়তা করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল ঋষিপাড়ার ৩০ বছরের যুবক নিতাই চন্দ্র দাস। কথা হয় শহীদ নিতাই দাসের স্ত্রী হাসি রানী দাস (৭০বছর) সজল নয়নে স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন আমার স্বামী খুব সুন্দর লম্বা চওড়া মানুষ ছিল। যাত্রা দলে তবলা বাজাতো। তখন খুব অভাবের সংসার। বড় ছেলে ৫ বছরের মহাদেব দাস ছোট ছেলের বছর হয়নাই। মিলিটারীদের ভয়ে স্বামীকে বাহিরে রোজগারে পাঠাতাম না। স্বামীরে হারানো ভয়ে ময়লা বেশে বিধবা শ্বাশুড়ীর সাথে ভিক্ষা করতাম। সারাদিনের ভিক্ষার পয়সা দিয়ে যা পারতাম তাই আনতাম। কিন্তু স্বামী আমাদেরকে না জানাইয়া গোপনে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাইতো। একদিন ভিক্ষা করতে গিয়ে ভিক্ষা করা হলো না স্বামীর লাশ নিয়ে ঘরে আইলাম। আমার সর্বস্ব শেষ হলো। দেশ স্বাধীন হলো । চারদিকে শুধু অভাব। অনেকের কাছে গিয়েছি একটু সাহায্যের জন্যে। শীতলক্ষ্যা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার তমিজউদ্দিন আহমেদ আনজু ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেটও সংগ্রহ করি। কিন্তু এদিয়ে কোন ফল হয় না। আমি চেষ্টা করছিলাম আমার নাতি-নাতনিদের লাইগা, শুনছি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সরকার চাকরী ব্যবস্থা করে। আজ আর পা চলে না। মুক্তিযোদ্ধা সহায়তা না পেলে বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন থেকে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। নাম হাসি হলেও আজ আর হাসি নেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিতাই দাসের বৃদ্ধ স্ত্রীর মুখে।