কিছু আবেগ অসম্পূর্ণই থেকে যায়, যেমনটি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পরেশ দাসের

Poresh Das
ইভা পাল, প্রকল্প উপ-সমন্বয়কারী :: এখন মরতে পারলেই বাঁচি বাক্যটি শুনতে কিছুটা অবাক হওয়ার মতো অনুভূতি জাগছে। হ্যাঁ আমারও লেগেছিল যখন প্রথমবার এরকম কথা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখে শুনি। সুদীপ্ত সূর্যটি তখন মাথার ওপরে। কথা বলতে বলতে কখনও কখনও খুব বিস্মিত হচ্ছিলাম। তারপরও গল্প শুনা নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরের নিতাইগঞ্জ (দাসপাড়া) ঋষিপাড়ার চৌদ্দ পুরুষের ভিটে বাড়িতে বসবাসরত ৬৯ বছরের পরেশ দাস এর সাথে। পরলোকগত বাবা সুরেন্দ্র দাস মাতা সুরবালা রানীর পাঁচ সন্তানের (২ছেলে ৩মেয়ে) মধ্যে পরেশ দাস ছিলেন ভাইয়ের মধ্যে ছোট এবং বোনদের বড়। ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমার ইচ্ছেতেই ছেলের নাম হয়েছিল পরেশ। জগত সংসারে সবার সুখের পরশ হবে। তাই ছিল তাদের ভাবনায়। কিন্তু যৌথ পরিবারের আর্থিক টানপোড়ার তাপ আর গুরুত্বহীনতায় প্রাইমারী পাশ করা হয়ে ওঠেনি পরেশের জীবনে। নারায়ণগঞ্জ শহরতলী শীতলক্ষ্যা প্রাইমারী স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ার সুযোগ পেলেও নিজের নাম ছাড়া আজ পরেশ দাস আর কোন বর্ণ, চিহ্ন, শব্দ লিখতে পারে না। স¤প্রদায়ের আদি ব্যবসায় বাবার সাথে সাহায্য করা আর দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিভাবে মানুষের উপকারে আসবে সে ভাবনায় কাটছিল যৌবনকাল। অন্যসব পিতামাতার মতো পরেশ দাসের বাবা-মা ভেবেছিল ছেলেকে বিয়ে করালেই বুঝি সংসারী হবে। একুশ বছরেই শুরু হয়।স্ত্রী আরতি রানী দাস এর সাথে পরেশ দাসের বিবাহিত জীবন। বছর খানেকের মাঝে পরেশ দাস প্রথম বাবা হবে পৃথিবী জানলো। তখন দেশে চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। যুবক পরেশ দাস তখন অস্থিরতার জীবন কাটাছিল। দিন যত যাচ্ছিল যৌবনের টগবগে সময় দেশমাতৃকার টানে পরেশ দাসকে তত বেশী সংসারের প্রতি উদাসীন করতে লাগলো। ১৯৭১ সাল মার্চ মাস তখন ডাক্তারি চিকিৎসায় স্ত্রী আরতি রানী তিন মাসের সšতান সম্ভবা। কিন্তু ২৫মার্চ রাতের ভয়বহতার পর নারায়ণগঞ্জে কাঠপট্টী কুরেরপার এলাকায় ক্যাপ্টেন সিরাজ সাহেবের নেতৃত্বে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরা এবং দেশ মাতৃকার অস্তিুত্ব রক্ষায় লড়ে যাওয়া। যুদ্ধ শেষ হয়, অবশেষে অস্ত্র জমা দিয়ে দেশের পতাকা হাতে তুলে জয় বাংলা বলে প্রাণ ভরে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে নিতে বিজয়ের আনন্দ অনুভব করা। বাড়িতেও আমার বিজয় যুদ্ধ আমাকে শুধু স্বাধীন একটা দেশই দেয়নি দিয়েছে আমার লক্ষ্মী মেয়ে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ ১৫ বছর টানা হুশিয়ারীতে কাজ করে। বর্তমানে আট মেয়ের বাবা পরেশ দাস। ছোট মেয়ে মমতা রানীর লেখাপড়ার কিছুটা সুযোগ পেলেও বাসন্তী রানী, জয়ন্তী রানী, ভজন্তী, জয়মনি, পলি, কনিকা আর মনিকা দাসের ভাগ্যেও জুটেনি লেখাপড়ার ছাপ। তাই মানুষের সহযোগীতা নিয়েই মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে দেন। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য পরেশ দাস যতটা সচেতন ছিল, ততটা সচেতন ছিলনা এত বড় সংসার চালানোর আয়ের রা¯তা চেনায়। নিয়মিত ভাবে হুশিয়ারীর কাজে যেতে সক্ষমতা না থাকায় অবশেষে সহজ শর্তে অন্যের রিক্সা চালানোতে গভীর মনোযোগ দেন। এখনও স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সংসার চালানোর আয়ের উৎস রিক্সা চালানো। কিন্তু বছর খানেক আগে রিক্স্রা চালানোর সময় একটা এক্সিডেন্টে ঘাড়ের হাড়ের সমস্যা হওয়ায় আগের মতো চালাতে পারেন না। আবেগে পরেশ দাস বলেন জীবন থেমে থাকেনি ২০১৩ সালে জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সার্ভে হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে পরিচয়পত্র এবং মাসে ৩০০/= করে ভাতা প্রাপ্তি শুরু হয়। তা আমার সংসারের খরচ চালাতে খুবই সাহায্য করতো। বর্তমানে মাসিক ১০,০০০/= করে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ভাতা পাচ্ছি। যা দিয়ে আমাদের দুজনের সংসার খরচ, চিকিৎসা খুব ভাল ভাবেই চলছে। সেজন্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এক পর্যায়ে দেশকে নিয়ে নিজের ভাবনা বা অনুভূতি বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা পরেশ দাস বলেন “যেজন্য দেশের স্বাধীনতা আনতে আমরা যুদ্ধ করেছি। দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি আজ আর ভাবতে ভাল লাগেনা। মরতে চাই। দিবে মরণকে এনে—-।” মুক্তিযোদ্ধা পরেশ দাসের দু’ চোখে স্পষ্ট ছিল কিছু অপ্রাপ্তি, কিছু অসহ্যনীয় ছায়া। আর কোন কথা বলতে চাইলেন না, এভাবেই শেষ করতে হলো। (মার্চ ২০১৮)
ইভা পাল, প্রকল্প উপ-সমন্বয়কারী, শারি