সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আমাদের করণীয়

সাংবাদিক, সম্পাদক বজলুর রহমান যার স্মরণে আজকের এ আয়োজন। তিনি ছিলেন চিন্তা ও কর্মে মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তার রাজনৈতিক শিক্ষা ও পেশাগত সাধনারও মূলে ছিল উদার ও উন্নত মানবিক চেতনা। আজকের আলোচনার বিষয় ‘সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আমাদের করণীয়।’ যে সমাজে নিশ্চিন্ত ও বিলাসবহুল জীবনযাপনকে প্রণোদনা দেয়া হয়, সেই সমাজে বজলুর রহমান ছিলেন উচ্চচিন্তা ও সাদামাটা জীবনযাপনের অনুপম দৃষ্টান্ত। তিনি যখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন দলের ও আদর্শের প্রতি গভীর আস্থা পোষণ করেও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতেন, তিনি যখন সাংবাদিকতা করেছেন কিংবা পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তখনো দেখেছি মুক্তচিন্তার সব মানুষকে একত্র করতে সচেষ্ট থাকতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বজলুর রহমান ছিলেন নিরাপসী। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নামে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রটির সম্পাদনার গুরু দায়িত্বই পালন করেননি, আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে গেছেন।

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ সম্প্রদায়গত চিন্তা। সেই সম্প্রদায় হতে পারে ভাষাভিত্তিক, ভূখ-ভিত্তিক, গোত্র ও বর্ণভিত্তিক কিংবা নৃতাত্তি্বক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ উপমহাদেশে সব কিছু ছাপিয়ে ধর্ম পরিচয়ই সম্প্রদায়ের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধর্মের ভিত্তিতে সাতচলি্লশে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ হয়েছে। আবার একাত্তরে এ দেশের মানুষ সেই পাকিস্তানকে নাকচ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ_ যার প্রথম সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সংবিধানের ৩৮(খ) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে লেখা ছিল : জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি ক. উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।

খ. উহা ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ, নারী-পুরুষ জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।

বা গ. উহার গঠন করিবার উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।

সংবিধানের উপরোক্ত ধারার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে জামায়াতে ইসলামী কিংবা সদ্য বিস্ফোরণ আকারে আবির্ভূত হেফাজতে ইসলামের প্রকাশ্য তৎপরতা চালানোর অধিকারই থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা সংবিধানের সেই আদিরূপ রক্ষা করতে পারিনি। সামরিক শাসকরা বুলেটের জোরে ক্ষমতায় এসে সংবিধান তছনছ করে দিয়েছেন। সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা পরিত্যক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, যা পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণাকে পরিপুষ্ট করতে সাহায্য করেছে। অতি সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন লংমার্চ ও মহাসমাবেশের নামে যে সহিংসতা দেখিয়েছে, তাতে জামায়াতে ইসলামকেই রাজনৈতিক ইসলামের একমাত্র পুরোধা ভাবার কারণ নেই।

২.

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সহিংস তৎপরতা চালিয়ে আসছিল, সরকারবিরোধী আন্দোলনের মোড়কে। দুঃখজনক হলেও সত্য এই কাজে তারা দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপিকে কাছে টানতে পেরেছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা- শুধু সরকার নয়, গোটা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, ট্রেন-বাসে আগুন দিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হতাহত করেছে। এর জবাবে সরকার ও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে, দলের অনেক নেতাকর্মীকে জেলে নিয়েছে। এখানে লড়াইটা দৃশ্যত সরকারের সঙ্গে চিহ্নিত রাজনৈতিক দলটির, যার সঙ্গে সম্প্রদায় হিসেবে দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী কোনভাবেই জড়িত নয়, যদিও আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি সেই চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীটি প্রবল বিক্রমে নিরীহ ও নিরস্ত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এটি হলো সেই পাকিস্তান আমলের মতো জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াস। বাংলাদেশে পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রতিক সহিংসতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচজন নিহত হয়েছেন, তাদের ৯৯টি মন্দিরে হামলা হয়েছে, যার অর্ধেকেরও বেশি লুট ও অগি্নসংযোগ এবং দুই হাজারের মতো বাড়িঘরে হামলা হয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর এ ধরনের হামলা এই প্রথম নয়। যে কোন জাতীয় দুর্যোগে সংখ্যালঘুরাই প্রথম ও প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। নিকট অতীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বড় ঘটনা ঘটেছে ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার গুজব ছড়িয়ে দিয়ে, ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এবং ২০০১ সালে ১ অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ও পরে। গত বছর সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধমন্দির ও তাদের বাড়িঘরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর আগে কখনোই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর এ রকম সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেনি। ২০০১ সালে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর সাংবাদিক-লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরী একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘হিন্দুরা এ দেশে থাকলে ভোট, আর না থাকলে সম্পত্তি।’ এ কথাটি যে সর্বৈব সত্য তার প্রমাণ অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা, যাতে দেখা গেছে স্বাধীনতার পর যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল বা আছে, তাদের নেতাকর্মীরা মিলেমিশেই সংখ্যালঘুদের ভূমি তথা সম্পত্তি দখল করেছেন। এই দখল প্রক্রিয়া এখনও চলছে।

সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করা অন্যায় নয়, কিন্তু সেই স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যদি আমরা অন্য সম্প্রদায়ের স্বার্থে আঘাত করি, তাদের জানমালের ক্ষতি করি; সেটি সাম্প্রদায়িকতা, যার প্রথম বিকট ও বীভৎস রূপ এ দেশের মানুষ ছেচলি্লশের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ করেছে, সাতচলি্লশে দেশভাগের সময়ে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হতে দেখলাম ১৯৫০ সালে, ১৯৬৪ সালে এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও। এরপর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জাতীয়তবাদী আন্দোলনের তরঙ্গে সেই সাম্প্রদায়িকতা কিছু সময়ের জন্য স্তিমিত হলেও ফের সেই অপশক্তির রুদ্রমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হতে সময় লাগেনি।

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সাংবিধানিকভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়। দুই সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশের সংবিধানে যে কালিমা লেপন করেছেন, গণতন্ত্রের ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়েও তা মুছে ফেলা যায়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাহাত্তরের সংবিধানে চার মূল নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি করছে। কিন্তু সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম রেখে যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অলীক কল্পনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে জোরালো আওয়াজ তুললেও সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের খ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কথা বলছেন না।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুপ্রিমকোর্ট যখন বহুলালোচিত ও নিন্দিত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেন, তখন সংবিধানের এই দুষ্ট ক্ষতও বাতিল হয়ে যায়। বর্তমান সরকার সেই অনুযায়ী সংবিধান মুদ্রণও করেছিল। পরবর্তীকালে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হলে দেখা যায়, সেই বাতিল ধারাটি পুনঃস্থাপিত হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে যারা মাঠ গরম করছেন, তত্ত্বাধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য শোরগোল তুলছেন তারাও ৩৮এর খ ধারা সম্পর্কে নীরব। এই হলো সংখ্যাগুরু মনস্তত্ত্ব। যতদিন আমরা এই মনস্তত্ত্ব্ব থেকে বেরিয়ে আসতে না পারব ততদিন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলা আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।

যে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান একাত্তরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন, একে অন্যের বিপদে সহায় হয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, সেই দেশে কেন সাম্প্রদায়িকতা এভাবে জেঁকে বসলো? কেন একটি সাম্প্রদায়িক তা-বের ক্ষত না শুকাতেই আরেকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে? এর জন্য প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি দায়ী হলেও অপ্রত্যক্ষ দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের আগে তো বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা জামায়াতে ইসলামী ছিল না। তারপরও কেন আমরা ভিন্ন নামে শত্রুসম্পত্তি আইনটি বহাল রাখলাম? চার দশক ধরে সেই আইন বাতিল করা নিয়ে কেন এত টালবাহানা? লেখক, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রটি সাম্প্রদায়িক হলেও সমাজটি অসাম্প্রদায়িক ছিল। আর এখন রাষ্ট্রটি অসাম্প্রদায়িক হলেও সমাজটি সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না।

আমি উপরে যেসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথা উল্লেখ করেছি, সেগুলো বড় দাগের ঘটনা, বহু হতাহত ও রক্তপাতের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে; কিন্তু এই বাংলাদেশে প্রতিদিনই কোন না কোন হিন্দু বাড়িতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় আক্রান্ত হতে দেখছি। নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর কোন না কোন সদস্য সংখ্যাগুরু বাঙালি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। সমতলে যেই সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদের নাম শুনলে আঁতকে ওঠে তারাই পাহাড়ে গিয়ে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর’ সেস্নাগান দেয়। মওলানা ভাসানী একবার বলেছিলেন, ‘নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না।’ তার কথাটিই একটু ঘুরিয়ে বলা যায় সাম্প্রদায়িকতা কারো গায়ে লেখা থাকে না। মানুষ তার প্রাত্যহিক আচার-আচরণেই প্রমাণ করে সে সাম্প্রদায়িক না ধর্মনিরপেক্ষ? ১৯৯০ সালে যখন স্বৈরাচার এরশাদের আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন হয়, তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলিত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ১৯৯২ সালের সহিংসতা চলাকালে আওয়ামী লীগ তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সেই ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। ২০০১ সালের ভয়াবহ সহিংসতায় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তারাও আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু এবারেও ক্ষমতায় এসে সরকার সেই ঘটনার তদন্ত করলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।

সে সময়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল: ঞযব পঁৎৎবহঃ ধিৎ ড়ভ ধঃঃধপশং ধমধরহংঃ ঃযব ঐরহফঁ ঈড়সসঁহরঃু রহ ইধহমষধফবংয নবমধহ নবভড়ৎব ঃযব মবহবৎধষ বষবপঃরড়হ ড়ভ ১ ঙপঃড়নবৎ ২০০১ যিবহ ঐরহফঁং বিৎব ৎবঢ়ড়ৎঃবফ নু ঃযৎবধঃবহবফ নু সবসনবৎং ড়ভ ঃযব ইঘচ ষবফ ধষষরধহপব যড়ষঃ ঃড় াড়ঃব, ঝরহপব রঃ ধিং ঢ়বৎপবরাবফ ঃযবরৎ াড়ঃব ড়িঁষফ নব পধংঃ ভড়ৎ ঃযব অধিসর খবধমঁব.

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে উদগ্রীব তারা সংখ্যালঘুদের বিষয়টি কখনোই আমলে নেন না। আধুনিক যুগে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র হতে পারে না। সৌদি আরবেও মুসলমানের বাইরে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। আর সৌদি বাদশাহ তো দেশটির নিরাপত্তা তথা হেফাজতের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন খ্রিস্টান-নাসারা শাসিত আমেরিকার হাতে। মুসলমানদের স্বপ্নের ভূমি পাকিস্তানে এখন চলছে তালেবানবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। ভারতে গেরুয়া পোশাকধারী বাল থাকারের দল মুসলমানদের বিতাড়িত করতে গিয়ে নিজেরাই রাজনীতি থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়েছে।

বাংলা ভূখ-ে শত শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান ও বৌদ্ধরা বাস করে আসছে। এর মধ্যে বহুবার শাসক বদল হয়েছেন। কেউ শাসকদের আনুকূল্য পেয়েছে, কেউ বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছে। তাদের ধর্ম বিশ্বাসে পার্থক্য থাকলেও আচার-আচরণে মিল ছিল। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় থেকে শিখেছে, ভাব বিনিময় করেছে। মুসলমান পীরের বাড়িতে যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভিড় জমাত, তেমনি সাধারণ মুসলমানও বিপদ-আপদে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে যেতে দ্বিধা করেনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি গ্রহণ করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় বাড়িয়ে দেয়, এ যেমন সত্যি, তেমনি সত্য হলো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনটা কমবেশি আগে থেকেই ছিল। আবার ওহাবি মতাবলম্বীরা খাঁটি ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে স্থানীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতিকে বেদাত হিসেবে গণ্য করে। বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের একটি উদাহরণ মাত্র। অন্যদিকে পৃথক নির্বাচনের পটভূমিতে বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ও সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্বে ভুগতে থাকে। যে হিন্দু মধ্যবিত্ত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে তা রোধ করতে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেছিল, সেই হিন্দু মধ্যবিত্তই সাতচলি্লশের দেশভাগে মুক্তির পথ খোঁজে।

৩.

২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের মাত্রাটি কত ভয়াবহ ছিল, তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনও অপ্রকাশিত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে দুঃখ-বেদনার মহাকাব্যের সামান্যই উঠে এসেছে। বিচারপতি লুতিফুর রহমানের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা স্বীকারই করতে চায়নি। আর নির্বাচিত চারদলীয় জোট সরকার রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বলে বিষয়টিকে লঘু করতে চেয়েছিল। তাদের এই কথিত রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিঘাতে যে হাজার হাজার সংখ্যালঘু সদস্য নির্যাতনের শিকার হলেন, ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবন-যাপন করতে বাধ্য হলেন, অনেকে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হলেন, বহু নারী ধর্ষণ ও লাঞ্ছনার শিকার হলেন, অথচ সেসব ঘটনার বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়িয়েছে।

যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, তাদের একাংশ এভাবে জিঘাংসু হয়ে উঠল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে ইতিহাসের দিকে। সাতচলি্লশে এ ভূখ-ে দ্বিজাতিতত্ত্ব নামের যে বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছিল, একাত্তরে তা সমূলে উৎপাটন করা যায়নি। ডালপালা কাটা হয়েছিল মাত্র। অনুকূল পরিবেশে সেই বিষবৃক্ষের পুনরুত্থান ঘটেছে। অনেকে বলবেন, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সব সদস্য তো সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালায়নি, সত্য। কিন্তু তারা দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতেও এগিয়ে আসেনি। বিভিন্ন সময়ে সরকার ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে এবং বৃহত্তর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ঔদাসীন্যে সে সময়ে ঘটেছিল ইতিহাসের ঘৃণ্যতর এথনিক ক্লিনজিং। আর এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থেকেও তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর ব্যক্তিগত কয়েকটি এলাকায় যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এত নিরীহ ও দরিদ্র যে অত্যাচারের প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনি। নীরবে চোখের জল ফেলেছে অথবা রাতের আঁধারে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অজানার পথে। পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের দেশত্যাগ কিংবা মুসলমানদের ভারত ত্যাগের কাহিনী আমরা জানি। স্বাধীন বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি দেখে অবাক হয়েছি, লজ্জিত ও ব্যথিত হয়েছি।

বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা পর্যায়ক্রমে হরাস পেয়েছে। ১৯৭১ সালে মোট জনসংখ্যার ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল হিন্দু, ১৯৮১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১২.১ শতাংশে, ১৯৯১ সালে ১১ ও ২০০১ সালে ৯ শতাংশ। বৌদ্ধদের সংখ্যা ০৭ ও খ্রিস্টান ০৩ শতাংশ। এই হরাসমান সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে কেউ বলতে পারে না।

২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বাপর সন্ত্রাসী ঘটনা সম্পর্কে বেসরকারি পর্যায়ে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। মূলত আক্রান্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দির ভিত্তিতে তৈরি ১০২ পৃষ্ঠার এ রিপোর্টটি এ দেশের সংখ্যালঘু (ধর্মীয় ও নৃতাত্তি্বক) সম্প্রদায়ের বিষাদ-সিন্ধু। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিতে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জনগণের সমস্যার এমন কোন দিক নেই, যা এতে আলোকপাত করা হয়নি। সংখ্যালঘু সমস্যার ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে শুরু করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মনমানসিকতা, বিশেষ করে এতে সন্ত্রাসনির্ভর ও আধিপত্য বিস্তারি রাজনীতির স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন ঘটনা ও পরিসংখ্যান দিয়ে।

সত্য যে সে সময় জনসমাজ তথা সিভিল সোসাইটির যতটা জোরালো প্রতিবাদ করার কথা ছিল, তা তারা করতে পারেনি; দুর্বল শ্রেণীর ওপর সবল তথা দুর্বৃত্তদের এ তা-বে লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ পেশাজীবীদের প্রতিবাদও ছিল নিরুত্তাপ। কাজটি অন্যায় হয়েছে_ এ কথা অনুচ্চকণ্ঠে স্বীকার করলেও কেউ আমির হোসেন চৌধুরীর মতো জীবন দিয়ে দুর্বল ও আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। এবারে কি এসেছেন?

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে একটি বেছে না নিয়ে নিরপেক্ষ থাকতে ভালোবাসে; পাছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সমর্থন হারাতে হয়। কিন্তু সেদিন গণতদন্ত কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রশক্তির ভ্রুকুটি ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে একটি সাহসী রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা উঠলেই অনেকে ভারতের গুজরাটে সংঘটিত ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রসঙ্গ তোলেন। গুজরাটের দাঙ্গা ভারতের শাসকগোষ্ঠীর মুখ উজ্জ্বল করেনি, বরং ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার দেশটির মুখে কালিমা লেপন করে দিয়েছে। আমরা কঠোর ভাষায় এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু ভারতের গুজরাটে দাঙ্গা হওয়ার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশেও হতে হবে। ঢাকায় বসে ভারতের দাঙ্গা থামানো যাবে না। সেখানকার দাঙ্গা থামানোর দায়িত্ব সে দেশের শাসকগোষ্ঠী, সুশীল সমাজ তথা জনগণের। ভারতের শাসকগোষ্ঠী ব্যর্থ হয়েছে, যেমন তারা ব্যর্থ হয়েছিল বাবরি মসজিদ রক্ষায়। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সারা ভারতের সিভিল সোসাইটি তথা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সোচ্চার ছিল। গুজরাটের লোমহর্ষক সব ঘটনার বিবরণ আমরা জানতে পাই সে দেশের পত্রিকার রিপোর্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভিডিওচিত্র ও লেখক-কবিদের সৃষ্টিশীল রচনায়। সাম্প্রদায়িক মোদি সরকারের আমলেই দাঙ্গাবাজদের শাস্তি হয়েছে, সীমিত হলেও প্রতিকার পেয়েছে আক্রান্ত মানুষগুলো।

গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় ও নৃতাত্তি্বক সংখ্যালঘু কেউই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বহু স্থানে বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের বাড়ি লুট করা কিংবা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া। ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘরছাড়া, দেশছাড়া করলেই তাদের সম্পত্তি দখল করা যাবে। অত্যাচারের ধরন সম্পর্কে তদন্ত কমিশনের বিশ্লেষণ হচ্ছে :

১. সংখ্যালঘুদের ওপর দৈহিক নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি

২. বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও অগি্নসংযোগ

৩. পূজা স্থান/ ম-প, মন্দির অপবিত্রকরণ এবং প্রতিমা ও দেবমূর্তি ভাঙচুর

৪. মোটা অঙ্কের টাকা দাবি ও দেশত্যাগ করানোর হুমকি

গণতদন্ত কমিশন সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু সুপারিশও পেশ করেছে। তারা বলেছে, ধর্মবাদী পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জয়লাভকারী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের আদি চরিত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। হাজার বছর ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের মানুষ বাস করে আসছে। ঐতিহাসিকভাবে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় ছিল। সমাজের সর্বক্ষেত্রে বহুত্ববাদিতা বা চষঁৎধষরংস-কে সমুন্নত রাখতে হবে, অন্যথায় আমরা ফিরে যাব ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের দিকে। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করা। যে চেতনা ও আদর্শের ভিত্তিতে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সে চেতনা ও আদর্শকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

গণতদন্ত কমিশন ধর্মীয় ও নৃতাত্তি্বক সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সাত দফা সুপারিশ পেশ করেছে, বর্তমান বাস্তবতায়ও যার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

দফাগুলো হচ্ছে :

১. বাংলাদেশ একটি বহুধর্মীয় ও একাধিক জাতিসত্তাভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সে কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা হলো জনসাধারণের সুখ-সমৃদ্ধি ও উন্নতির পূর্বশর্ত_এ বিশ্বাসে সরকারকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে এবং জনগণের মধ্যে তার এই নৈতিক অবস্থান ও তার কার্যকারণ স্পষ্টাকারে তুলে ধরতে ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে প্রশাসনিক, নিরাপত্তা, শিক্ষাব্যবস্থাসহ সব রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমঅধিকারনীতির প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘু নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, তা নিরোধকল্পে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে জনপ্রশাসনে (ঈরারষ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ), শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীতে পুলিশ, বিডিআর, আনসার, সেনাবাহিনী ইত্যাদিতে ক্রমবর্ধমান হারে নিয়োগ করে এ উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে হবে।

২. সংবিধানে পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল, যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী যেসব বাতিল করে সংবিধানকে ১৯৭২ সালের আদিরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সরকারকে।

৩. রাষ্ট্রদর্শনে ধর্ম সম্পর্কে কোন একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটানো ও তদানুযায়ী প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করা যাবে না। কারণ, রাষ্ট্র ও সরকারের দৃষ্টিতে সব ধর্ম সমান।

৪. (ক) সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও উপজাতিসহ সব ধর্মীয়, ভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষকে জাতির মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্নকারী ও বৈষম্যমূলক যেসব আইন বা সরকারি বিধিনিষেধ প্রণীত হয়েছে, যা তাদের সাংবিধানিক অধিকারকে সংকুচিত করেছে (যেমন অর্পিত সম্পত্তি আইন, উত্তরাধিকার আইন) সেগুলো বাতিল করতে হবে।

(খ) ১৯৯৭ সালে সইকৃত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি’র সব প্রস্তাব যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারকে দৃঢ় ও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে সেখানকার পার্বত্য সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা ও শান্তি ফিরে আসে এবং জুন্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

(গ) দেশের সংবিধান অনুযায়ী যে কোন নাগরিকের দেশের যে কোন অঞ্চলে বাস করার অধিকার স্বীকৃত হলেও, সরকার এমন কোন পদক্ষেপ নেবে না, যাতে কোন অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে আদিবাসী-অধ্যুষিত জেলাগুলোয়, সিলেটে মনিপুরী ও খাসিয়া জন-অধ্যুষিত অঞ্চলে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো এলাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোয় জনতাত্তি্বক অনুপাতে দৃশ্যমান বৈষম্যের সৃষ্টি না হয় এবং স্থানীয় ও বহিরাগত সংকট দেখা না দেয়।

(ঘ) ১৯৯২ সালে ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত (৪৭/১৩৫ নং প্রস্তাবনা) ‘জাতিগত অথবা নৃতাত্তি্বক, ধর্মীয় অথবা ভাষাগত সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের অধিকারের ঘোষণায়’ তাদের অধিকার রক্ষায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে যেসব পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১-৮), বাংলাদেশ সরকারকে সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং গৃহীত ব্যবস্থাদি সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করবে।

(ঙ) সংখ্যালঘুদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহাসিক, পারিবারিক ও উত্তরাধিকার নিয়ম-কানুনগুলোর স্বীকৃতিকে বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতিতে আত্তীকৃত করে এই জনগোষ্ঠীভুক্ত জনমানুষের জাতীয় মূল স্রোতের অঙ্গীভূত করা, নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন না দিয়ে_এই লক্ষ্যে সরকারকে নিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

(চ) জাতিসংঘ মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণা কোন রাষ্ট্রের জাতিধর্ম-নির্বিশেষে নাগরিকের যেসব অধিকার (বিশেষ করে ধারা-৩ থেকে ৭, ১২, ১৬, ২০, ২১খ ধারায় বর্ণিত অধিকারগুলো) নিশ্চিত করা হয়েছে, তা রক্ষা করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

৫. (ক) সংখ্যালঘু জনগণের ওপর যে আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে, প্রকাশ্যে তার নিন্দা জ্ঞাপন করতে হবে।

(খ) অবিলম্বে সব শ্রেণীর সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোন ধরনের নির্যাতন বন্ধ করা ও উপদ্রুত এলাকার নির্যাতনকারীদের, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানে নির্বিশেষে উপযুক্ত বিচারের সম্মুখীন করাতে হবে।

(গ) সব শ্রেণীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন রোধ ও নিরাপত্তাদানের জন্য পুলিশ ও জনপ্রশাসনকে দৃঢ় ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করাতে হবে।

(ঘ) সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থ হয়েছে, তার বা তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্যচ্যুতির দায়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা।

(ঙ) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণদান সুনিশ্চিত করা।

৬. (ক) দেশের অভ্যন্তরে বাস্তচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

(খ) দেশত্যাগীদের সুষ্ঠু পরিবেশে দেশে প্রত্যাগমন করিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

৭. অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ (ঘধঃরড়হধষ ঐঁসধহ ৎরমযঃং ঈড়সসরংংরড়হ) গঠন সম্পূর্ণকরণ। এ কমিশনের অবশ্যই ‘সংখ্যালঘু, নারী, শিশুবিষয়ক’ পরিচ্ছেদগুলো বিশেষ গুরুত্ব পাবে এবং সব শ্রেণীর সংখ্যালঘু ও নারীদের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে।

সামনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখেও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যাতে ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

২০০১-এর পটভূমিতে গণতদন্ত কমিশন কী কী করতে হবে তার একটি তালিকা দিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলো এসব সুপারিশের একটিও রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করেনি। চারদলীয় জোট সরকার বাস্তবায়ন করবে না। তত্ত্বাধায়ক সরকারের এজেন্ডায়ও বিষয়টি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার গত চার বছরেও অপরাধীদের আসামির কাঠগড়ায় নিতে কেন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিল না?

গণতদন্ত কমিশন কী কী করতে হবে তার তালিকা দিয়েছে। এর সঙ্গে আমি কী কী করতে হবে না সেই তালিকাটিও যোগ করতে চাই।

রাষ্ট্র কোন ধর্মকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র হবে সবার।

রাষ্ট্র কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আনুকূল্য দেখাবে না।

রাষ্ট্র কোন ধর্মাবলম্বীর প্রতি আনুকূল্য বা বৈষম্য দেখাতে পারবে না।

আগামী নির্বাচনে কোন সাম্প্রদায়িক/ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে আঁতাত বা সমঝোতা করা যাবে না।

নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক বা ধর্ম বিশেষের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রচারণা চালানো যাবে না।

বাংলাদেশকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, উদার মুসলিম দেশ_ এ ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালানো যাবে না

রাষ্ট্রের নাগরিকরা অবাধে ধর্ম পালন করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম চর্চা করবে না

নাগরিককে সংখ্যালঘু ও সংখ্যা গুরু_এইভাবে ভাগ করা যাবে না।

অর্পিত সম্পত্তি আইন রাখা যাবে না।

নৃতাতি্বক জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বাইরে রাখা যাবে না।

একাত্তরে সব মানুষের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে সবার দেশ হোক বাংলাদেশ।

[২৪ মে রাজধানীতে বজলুর রহমান ফাউন্ডেশন আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে পঠিত]

Reference