একাত্তর স্টাইলে আবার হিন্দু বাড়ি মন্দিরে হামলা, আগুন জামায়াতী সন্ত্রাসে আতঙ্কে সংখ্যালঘুরা

জামায়াত-শিবির সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট অব্যাহত রেখেছে। দেশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এসব হামলা চালানো হচ্ছে। সাঈদীর মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এ হামলা শুরু হলেও তা অব্যাহত রয়েছে। শুধু বাড়িঘরে হামলা নয়, পরিকল্পিতভাবে অগ্নিসংযোগ এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও মূর্তি ভেঙ্গে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে এবং ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে জামাতের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবারই হরতাল ডাকা হয়। সারাদিন শান্তিপূর্ণ হরতাল চললেও দুপুরে রায়ের পর থেকে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। চলতে থাকে দেশজুড়ে জামায়াতের সহিংস তা-ব। প্রথম দিনেই তাদের এ তা-বে ঝরে যায় প্রায় ৪০ তাজা প্রাণ। এ তা-বে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়। বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রতিমাসহ মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ তা-ব চালিয়েছে।
বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সংখ্যালঘুদের ওপর জামায়াতী তা-ব আজও অব্যাহত। শনিবার গভীর রাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীগঞ্জ উত্তর মহেশপুর গ্রামে ১২ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষক পরিবারের বাড়ির ও খড়ের গাদায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাঁদের গ্রামে আগুন লাগিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন। তারা এখন নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন। নতুন হামলার আশঙ্কায় তারা এখনও আতঙ্কে কাটাচ্ছেন। জানা গেছে হিন্দু বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপসানালয়ে আগুন দেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ সময়কে বেছে নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে রাত যখন গভীর হচ্ছে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ছে তখনই নির্বিঘেœ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। শনিবার দিনাজপুরের বারোটি গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে রাত ১২টার পরে। জানা গেছে এ সময় গ্রামের সব কৃষক ঘুমিয়ে ছিল। পরে এলাকাবাসীর চিৎকারে চিহ্নিত এসব সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। তবে পালিয়ে গেলেও তারা তাদের স্পষ্ট চিহ্ন রেখে গেছে। কারণ আগে থেকেই তারা সংখ্যালঘুদের হুমকি দিয়ে আসছিল।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে সংখ্যালঘুরা জামায়াত-শিবিরে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ওদিন দেশের নোয়াখালী, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়। জানা যায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের সর্বজনীন পুজো মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়ও দুটি মন্দিরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে দুটি ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত। তবে অনেক এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এভাবে হামলা করা হলেও অনেকে ভয়ে হামলার কথা যেমন স্বীকার করছে না। তেমনি কারা এর সঙ্গে জড়িত তাও মুখ ফুটে বলার সাহস পাচ্ছে না। নিরাপত্তহীনতায় ভুগছে তারা।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় চিংড়াখালী ইউনিয়নে শিংজোড় গ্রামে সর্বজনীন পুজো মন্দিরে হামলা চালিয়ে দুর্গা প্রতিমার গলা ভেঙ্গে ফেলার পাশাপাশি সরস্বতী, গণেশ ও কালী প্রতিমা উল্টে ফেলে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা করা হয়।
একইভাবে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার গাইয়ারচর গ্রামে পূর্ণবক্ষ হরিচাঁদ গুরুদাস সেবা আশ্রম ও রাধাগোবিন্দ নামে দুটি মন্দির বৃহস্পতিবার রাতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়া হয়। এলাকাবাসী দাবি করেছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এ আগুন দেয়। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সড়কের পাশে শিবমন্দিরে আক্রমণ চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর করে।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জ ইউনিয়নের আল্লাদিনগর গ্রামের ১৩ পরিবারের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। সবকিছু হারিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো এখন অসহায় জীবনযাপন করছে। বৃহস্পতিবার জামায়াত-শিবিরের হামলা ও তা-রের সময় এ এলাকার ৮ বাড়ির ৪০ ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বসতঘর ও রান্না ঘরসহ ১৭ পরিবারের ৩০ ঘর সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এ সময় ৬ মন্দিরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব মন্দিরের মধ্যে রয়েছে রাজগঞ্জ বাজারের কালীমন্দির, বাজারের পশ্চিমপাশের কালীতলার নবনির্মিত কালীমন্দির, বণিকবাড়ির সেবা ঠাকুর আশ্রম মন্দির, বণিকবাড়ির মনসামন্দির, কুরি বাড়ির নিজস্ব মন্দির, কালীহাটের কালী মন্দির।
বৃহস্পতিবার রাতের পর শুক্রবার রাতেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। এ ছাড়া তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। অব্যাহত হামলার অংশ হিসেবে গাজীপুরে সদর উপজেলায় কাশমপুর নামাবাজারে কালীমন্দিরে পাশের ম-পে শুক্রবার রাতে সরস্বতী প্রতিমা ভাংচুর করা হয়। এ সময় তারা প্রতিমার মাথা বীণাসহ বা-হাত ভেঙ্গে ফেলে দেয়। রাতে আঁধারে এসব কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় নলচিড়া ইউনিয়নের পিংলাকাঠি গ্রামে সর্বজনীন দুর্গামন্দিরে শুক্রবার রাতে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাত আড়াইটায় এ অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলায় কালীমন্দিরে আগুন দেয় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌরসভার চরসীতা এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে শুক্রবার গভীর রাতে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় খেওড়া বাজারের ১১ দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে চারটি দোকান হিন্দু সম্প্রদায়ের।
এদিকে রবিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ নিরীহ জনগণের ওপর নির্যাতন, উপাসনালয় এবং বসত-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে ও দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হয়। মানববন্ধনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, বিএমএর মহাসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান, সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া, বিএসএমএমইউর প্রক্টর অধ্যাপক ডা. এএসএম জাকারিয়া স্বপনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, সেবক-সেবিকা ও কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন।

Reference