এবার বৌদ্ধদের ওপর হামলা

সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘরের ওপর হামলার পরে দুর্বৃত্তরা এবার হামলা করেছে বৌদ্ধমন্দিরে। গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ উপাসনালয়ের ওপর হামলার খবর দৈনিকগুলোতে আসছে। সর্বশেষ গত রোববার গভীর রাতে বোয়ালখালী উপজেলার খরনদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্ঠাপুরা গ্রামের শাক্যসুনি বৌদ্ধমন্দিরে হামলা হয়েছে। বোয়ালখালী থানার ওসির উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, দুষ্কৃতকারীরা ওই মন্দিরের দান বাক্সটি ভেঙে টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে। বুদ্ধমূর্তির গায়ে জড়ানো কাপড়ে (চীবর) আগুন দেয়া হয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা করছি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কি চলতেই থাকবে। গত বছরের শেষদিকে চট্টগ্রামের রামুতে বৌদ্ধদের ওপর ঘটে গেল নৃশংস সন্ত্রাস। তারপরে সাঈদীর মামলার রায়কে কেন্দ্র করে শুরু হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দেশব্যাপী হামলা। হাজার হাজার মন্দির, বিগ্রহ, ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে লুটপাট করে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এখন আবার শুরু হয়েছে বৌদ্ধদের ওপর হামলা।

এসব হামলার পিছনের কারণটি পরিষ্কার। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিম-লে সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন এবং বিতাড়িত করার একটি আদর্শিক ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে। কারণ দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের যে উত্থান হয়েছে তা এখন অস্বীকার করার উপায় নেই। উগ্রবাদের প্রতিনিধিত্বকারী ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে আপাত মতপার্থক্য থাকলেও অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের সবারই দৃষ্টিভঙ্গি এক এবং অদ্বিতীয়। ধর্মীয় মতে আদর্শিকভাবে সংখ্যালঘুদের পবিত্র আমানত মনে করা হলেও কোন মতেই সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব এরা মানতে নারাজ। ভেতরে ভেতরে সব ধরনের মূর্তিপূজারিদের উৎখাত করাকেই পবিত্রতম দায়িত্ব বলে এরা মনে করে। সুতরাং এভাবেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উৎখাতের একটি আদর্শিক পটভূমি দেশে তৈরি হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। সুতরাং বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেশে সংখ্যালঘুরা আদতেই থাকতে পারবে কি না সেই প্রশ্নই দেখা দিচ্ছে।

সরকার এখানে কী করছে সেটাই প্রশ্ন। সরকার কি শুধুই সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ছিটেফোঁটা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও মৌখিক সহানুভূতি প্রকাশের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখবে এবং প্রশ্নই করতে হয় এখন। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে কারা কারা জামায়াত-শিবিরবিরোধী তাদের বাছাই করে জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করে জামায়াতকে দুর্বল করার হিসাব-নিকাশেই মনে হয় সরকার কালক্ষেপণ করছে। এটি আত্মঘাতী রাজনীতিরই নামান্তর বলা যায়। ধর্মভিত্তিক সব দল সে জামায়াতের পক্ষে বিপক্ষে যেই হোক, মোটা দাগে এরা সবাই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বিরোধী। এবং অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে একাট্টা। উপরে উপরে ইসলামের মহান উদারতার কথা বললেও এদের কায়েমি স্বার্থ উৎসারিত ভূমিকা এক ও অভিন্ন। আর তাহলো দেশ থেকে অমুসলিমদের সমূলে বিতাড়ন। পাকিস্তান এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় শুধু পুলিশি ভূমিকা এখানে যথার্থ বলে মনে হয় না। তারপরেও সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে যাওয়া একের পর এক সহিংসতাই তার প্রমাণ। অনভিপ্রেত এই ঘটনা রোধে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা দান ব্যবস্থাটি জোরদার করতে হবে। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যে আদর্শিক ভাবধারার উত্থান ঘটেছে, সরকারকে তা প্রতিহত করতে হবে। এখানে হিসাব-নিকাশ করে আপস-রফা করার কোন অবকাশ নেই। কোন স্পেস নেই। এটা সরকারকে সর্বাগ্রে উপলব্ধি করতে হবে এবং সেই মর্মে দেশের সব ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শক্তির সমাবেশ ঘটাতে হবে ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানের এটাই একমাত্র পথ বলে আমরা মনে করি। কারণ কোন সরকারের পক্ষেই প্রতিটি সংখ্যালঘুর বাড়িতে গিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একমাত্র জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটিয়েই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। কাজটা সরকারকেই করতে হবে।

Reference