জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের ৯ দিনের তা-ব : বিভিন্ন স্থানে হিন্দু নাগরিকদের বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মন্দিরে ভাঙচুর আগুন

জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গত ৯ দিনের তা-ব ও সহিংসতায় বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু নাগরিকদের বাড়িঘর, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে ও লুটপাট করেছে। তাদের তা-বে হিন্দু নাগরিকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। এরপরও তা-ব থামেনি। এইসব ঘটনায় এলাকার সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে মামলা হলেও মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। যার কারণে হিন্দু নাগরিকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, হিন্দু নাগরিকদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দির ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে, জামায়াত-শিবিরের পাঁচশ’র বেশি সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে। আরও ধরপাকড় অভিযান চলছে। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সংবাদকে জানান, বাংলাদেশে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কোনক্রমে বরদাস্ত করা হবে না। যেসব জায়গায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানো হয়েছে সেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। পলাতক আসামিদের ধরার জন্য পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে। পুলিশ তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা সাঈদীর ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর থেকে দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তা-ব শুরু করে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে প্রায় ৩০০ স্থানে হিন্দু নাগরিকদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও মন্দির ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করে। তাদের তা-বে শত শত হিন্দু পরিবার এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেকে পুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘরে ছাইয়ের ওপর বসে কান্নাকাটি করছে। অনেকেই সবকিছু হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এরপরও তা-ব থেমে নেই। সর্বশেষ গত শুক্রবার রংপুরে মন্দির ভাঙচুর ও আগুন লাগানো হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ও চট্টগ্রাম জেলায় ৪/৫টি স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও মন্দিরে অগি্নসংযোগ করা হয়েছে। আর কুমিল্লার একটি স্থানে ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ করা হয়েছে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ১৬টি স্থানে, লক্ষ্মীপুর জেলায় ২টি স্থানে, রংপুরে একটি স্থানে, জয়পুরহাটে ২২টি স্থানে, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহে ১০৭টি স্পটে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করা হয়। বরিশালে ১টি স্থানেসহ প্রায় ৩০০ স্পটে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ, লুটপাট ও হিন্দু নাগরিকদের মারপিট করা হয়। অনেকেই ভিটামাটি রক্ষা করার চেষ্টা করতে গেলে শিশু সন্তানদের সামনে মা-বাবাকে মারপিট করা হয়। যা ১৯৭১ সালের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ প্রতিনিধি মোস্তফা মহসিন জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি বেগমগঞ্জে ১০ দিন ধরে তা-ব চালিয়েছে। এই তা-বের মূল টার্গেট ছিল হিন্দু পরিবারগুলো। গত ১০ দিনে তা-বকারীরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু নাগরিকদের শতাধিক বাড়িতে ভাঙচুর এবং অগি্নসংযোগ করেছে।

গতকাল শনিবার সরেজমিন খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, বেগমগঞ্জে হিন্দু পরিবারের লোকজনের এখনও আতঙ্ক কাটেনি। অধিকাংশ পরিবার নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতা করা হলেও তা ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় অপ্রতুল।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জ, ছয়ানী, আলাইয়ারপুর, রফিকপুর, একলাশপুর এলাকার ৪৭টি পরিবারের বসতঘরে আগুন লাগিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বসতবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং লুটপাট চালায়। এর মধ্যে রাজগঞ্জ ইউনিয়নে হিন্দুদের ৩০টি বসতবাড়িসহ ২টি মন্দিরে অগি্নসংযোগ এবং ভাঙচুর করে। আলাইয়ারপুর ইউনিয়নের দোয়ালিয়ায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুর রহিম ওরফে মাছ রহিমের বসতঘরে অগি্নসংযোগ করে, আমিন বাজারে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেমের ওয়ার্কশপ, ডা. শংকর কুমার দে’র ফার্মেসিতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করে। এ ছাড়াও রসুলপুর ইউনিয়নের রফিকপুর গ্রামের ঠাকুর বাড়ি, নাপিত বাড়িতে অগি্নসংযোগ করা হয়। রাজগঞ্জের স্থানীয় লোকজন জানায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে হামলা হয় হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে।

ভাঙচুরের আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা হারুনুর রশিদ এবং পার্শ্ববর্তী ছয়ানী ইউপি চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা জামাল উদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজগঞ্জ বাজারে একটি মাহফিল থেকে উস্কানিমূলক ও হিন্দুদের সম্পর্কে নানা কটূক্তি ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হয়। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজগঞ্জে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সঙ্গে পাশের ছয়ানী, জিরতলী এবং সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়ন থেকে জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির লোকজনকে জড়ো করা হয়। সকালে তারা রাজগঞ্জ বাজারে জঙ্গি মিছিল করে একটি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করে। সাঈদীর রায় ঘোষণা করার পরপরই মিছিল সহকারে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট এবং গানপাউডার ও পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়া হয়। খবর পেয়ে বেগমগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই বসতঘর ও মন্দির পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বসতঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে অগি্নসংযোগ ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় থানায় মামলা হলেও জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির নেতা এবং ক্যাডাররা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

জেলা ডিবি পুলিশ জেলা শহর মাইজদী থেকে গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদকে গ্রেফতার করলেও ছয়ানী ইউপি চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা জামাল উদ্দিন এবং তার পালিত ক্যাডারদের থানা পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।

নোয়াখালী জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের নেতা বাবু বিনয় কিশোর রায় বলেন, উপজেলার রাজগঞ্জে যে তা-ব ও নৈরাজ্য করা হয়েছে তা ‘৭১ সালকেও হার মানিয়েছে। তিনি এর তীব্র নিন্দা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে এ ঘটনার মূল হোতাদের গ্রেফতারপূর্বক বিচারের জোর দাবি জানান।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার নুরুল হক জানান, বেগমগঞ্জ উপজেলা পরিষদের এবং সরকারি তহবিল থেকে দান অনুদান দিয়ে রাজগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু নাগরিকদের পরিবারগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হয়েছে এবং এ নারকীয় ঘটনার মূল হোতাদের গ্রেফতারপূর্বক আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে আমাদের জোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ জানায়, চট্টগ্রামের বাঁশখালি এলাকায় জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ৩টি হিন্দু নাগরিকের বাড়ি, ১টি মন্দিরে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করেছে। এইসব ঘটনায় থানায় মামলা করা হয়েছে। আসামিদের ধরপাকড় করা হচ্ছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা একটি মন্দির ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি মাহমুদুল গনি রিজন জানান গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে জামায়াত-শিবির ব্যাপক তা-ব চালায়। তারা বাহ্মণডাঙ্গার পুলিশ ফাঁড়ির ৪ পুলিশকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এ ঘটনায় মোট ৯ জন নিহত হন। বৃহস্পতিবার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি দেখিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

এ ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে ১২টিসহ মোট ২০টি মামলা করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ২৫ হাজার জনকে। দায়েরকৃত মামলার মধ্যে পুলিশ বাদী হয়েছে ২টিতে এবং অন্য মামলাগুলোতে বাদী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনসহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা। সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি জানান, অধিকাংশ মামলার আসামি হিসেবে জামায়াত নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল আজিজ, জামায়াতের গাইবান্ধা জেলা সেক্রেটারি আবদুল করিম, উপজেলা আমির, সেক্রেটারি এবং পৌর আমিরসহ জামায়াতের নেতাকর্মীদের নাম রয়েছে। তিনি আরও জানান এ পর্যন্ত মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান হাবীবের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাঈদীর ফাঁসির আদেশ প্রকাশের পর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত জামায়াত-শিবির তা-ব চালিয়ে ১৬৭টি মুসলমানের দোকান, ৫৫টি হিন্দু নাগরিকদের দোকান, ৮টি মুসলমানের বাড়ি, ৩টি হিন্দু বাড়ি, ৪টি মন্দির, ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৪টি আওয়ামী লীগ অফিস, ২টি মুক্তিযোদ্ধা অফিস, ৬টি সরকারি ভবন, একটি গণউন্নয়ন অফিস, একটি ইসলাম শিপ বিল্ডার্স অফিস, একটি রেলস্টেশন ও একটি ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র ভাঙচুর করে। যার সম্পদের মূল্য প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা।

এদিকে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রেল স্টেশন ও বাড়িঘড়গুলো এখনও সংস্কার শুরু করেনি ক্ষতিগ্রস্তরা। তাদের মনে নিরাপত্তাহীনতার ছাপ দেখা গেছে। আতঙ্ক যেন কাটছে না এলাকাজুড়ে।

গত ৬ মার্চ রংপুর বিভাগীয় কমিশনার সুন্দরগঞ্জে জামায়াতের তা-বস্থল পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া সিপিবি ও বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সুন্দরগঞ্জ প্রতিনিধি আ. মতিন সরকার জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ও ১ মার্চ শুক্রবার জামায়াত-শিবিরের তা-বের চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে । শুধু সংখ্যালঘু পরিবারই নয় আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। বিভিন্ন সময় হামলার গুজব ছড়িয়ে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এই জনপদের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাংবাদিকরাও নির্বিঘ্নে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তাদেরও নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে।

বিশেষ করে চাঁদে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি দেখা যাওয়ার গুজবের পর সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক আরও বেশি করে দানা বাধছে। মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও হুমকি দেয়া হচ্ছে অনেক মানুষকে। ৬ মার্চ বুধবার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত শান্তিরাম ইউনিয়নের পরাণ গ্রাম, গংসার হাট, রামজীবনের শিলপাড়া, নিজ পাড়া, বামনডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে এ তথ্য জানা গেছে। এ অবস্থা থেকে ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্য মানুষের মনে সাহস জোগাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিক ও কর্মী এবং অন্য ধর্মাবলম্বী পরিবারের সদস্যরা রাত জেগে বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন ।

পরাণ গ্রামের কুসুম বালা জানালেন, হামার বাড়িত হামলা চালেয়া বৃহস্পতিবার রাইতে সইগ কিছু ভাঙ্গি ফেলাইছে জামায়াত-শিবিরের মাইনসেরা। মন্দিরের খানও ভাঙচে। এখনও ভয়ে আতঙ্কে হামার রাইতোত ঘুম আসে না। ভয়ে ভয়ে থাকোম কখন বেন ওমরা ফির আসিয়া বাড়িত আগুন ধরি দ্যায়। আর হামাক মারি ফ্যালায়।’

চপলা রানী সে দিনের কথা বর্ণনা করলেন এভাবে_ ‘হামার বাড়িত তখন কোন পুরুষ মানুষ আছিল না। মুই আর মোর জাও আর দুক্না ছইল। জামায়াত-শিবিরের মাইনসেরা লাঠিসোটাঁ নিয়া কুসুম বালার বাড়িত ভাঙচুর করিয়া হামার বাড়িত দিকে যখন আসবের নাইগচে তখন হামরা দুই জাও ছইল দুক্না নিয়া ঘরোত তালা না দিয়াই বাড়ি ছাড়ি পলাইছি।

গংসার হাটসহ পার্শ্ববর্তী ছোটখাটো হাটগুলো পরিদর্শন করে জানা গেল সেগুলো এখন আর আগের মতো জমছে না। সন্ধ্যা লাগার আগেই ভয়ে লোকজন দোকানপাট বন্ধ করে চলে যায়। অথচ আগে রাত ১০টা ১১টা পর্যন্ত গ্রামীণ হাটগুলো ছিল কেনা বেচায় জমজমাট। গংসার হাটের এক হাটুরে আবদুর রউফ জানালেন_ ‘ওই হামলার দিন থাকিয়াই হাটোত মানুষ বলতেই নাই। ভয়ে আতঙ্কে সগলে আচে, দুই চারজন কেনাকাটার জন্য আইসে আর যায়।’ ওর কথাকে সায় জানালেন গংসার হাটে আসা আর সোলায়মান আলী_ ‘একন হাটবাজার আর হামার গ্রামগঞ্জের অবস্থা এমন হইচে কাঁই যে কখন কাক মারবে, আর কাঁই যে কাক কি করবে সেই ভয়ে লোকজন হাটবাজারে আসা কমে দিচ্ছে।

স্থানীয় সংবাদ কর্মী নুরে আলম সিদ্দিকী জানালেন_ ‘বৃহস্পতিবার যখন বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন এবং রেল লাইনে অগি্নসংযোগ করা হয় সেই ছবিটি তিনি মোবাইলে তোলার চেষ্টা করছিলেন। তখন জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা তেড়ে এসে তার হাতে লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং তার মোবাইলটি ছিনিয়ে নেয়। সুন্দরগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি হাবিবুর রহমান হবি জানালেন, স্থানীয় জনগণ এবং সাংবাদিকদের মধ্যে এখনও চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের বিভিন্ন লোক দিয়ে এবং মোবাইলে মেসেজে পাঠিয়েও হুমকি দেয়া হচ্ছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জসিম উদ্দিন আহমেদ বুধবার ৬ মার্চ দিনভর সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রশাসক ড. কাজী আনোয়ারুল হক, পুলিশ সুপার, নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন_ ‘গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় জামায়াত-শিবিরের এই তা-ব ‘৭১’র পাক হানাদার বাহিনীর নাশকতাকেও হার মানিয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনার পৃথক পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

একই দিনে সিপিবির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য শামসুজ্জামান সেলিম এবং বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ওই দু’দলের জেলা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ একটি প্রতিনিধিদল সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তাদের সঙ্গে গাইবান্ধা জেলা সিপিবির সভাপতি ওয়াজিউর রহমান রাফেল, সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, জেলা বাসদের আহ্বায়ক আহসান হাবীব সাঈদ, সদস্য সচিব মঞ্জুর আলম মিঠুসহ অন্য নেতারা এলাকা পরিদর্শন করেন। পরে বুধবার সন্ধ্যায় গাইবান্ধা প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে তারা জামায়াত-শিবিরের ভয়াবহ তা-বের বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় করেন। তারা বলেন_ ‘গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের জামায়াত-শিবিরের দু’দিনের তা-বে সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ভয়াবহ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। এখানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ ক্যাম্প, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, রেল স্টেশনেও হামলা চালানো হয়েছে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং তাদের অফিসও হামলা থেকে বাদ যায়নি।’

শামসুজ্জামান সেলিম ও শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী সাংবাদিকদের বলেন, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ও ১ মার্চ শুক্রবারে সুন্দরগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী তা-ব ও কিলিং মিশন ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী বা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এখনও পাশে দাঁড়ায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের মধ্যে এখনও ভয়ভীতি এবং পরবর্তী হামলা সম্পর্কে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা আবারও ভয়াবহ আক্রমণ চালাতে পারে। সুতরাং এই সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে পরবর্তীতে জামায়াত-শিবিরের এই সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তারা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টিও সরকারের দৃষ্টিতে আনা দরকার বলে উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তারাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সুপারিশে এলাকার মানুষ কর্তৃক ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে পুলিশের কাছে এক জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারকে ধরিয়ে দেয়ার পরও তাকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি তারা উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ওই দু’দিনে জামায়াত-শিবিরের তা-বে ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৮ ব্যক্তির নির্মম মৃত্যু হয়। সরকারি তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, দু’দিনের হামলায় প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে মুসলিম সমপ্রদায়ের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ১৬৭টি, হিন্দু সমপ্রদায়ের ৫৫টি, ৮টি মুসলিম পরিবারের বসতবাড়ি, ৩টি হিন্দু পরিবারের বসতবাড়ি ও ৪টি মন্দির, ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৪টি আওয়ামী লীগ অফিস, ১টি জাতীয় পার্টি, ১টি জাসদ অফিস, ২টি মুক্তিযোদ্ধা অফিস, ২টি সরকারি ভবন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গণউন্নয়ন কেন্দ্র, ইসলাম শিপ বিল্ডার্স ও ইউনিয়ন তথ্য অফিসে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি, বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।

জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধি জানান, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় রামচন্দ্রপুর গ্রামে কালিমন্দির ও কানাই উপজেলা শিবমন্দির ভাঙচুর ও আগুন লাগানো হয়।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, সাক্ষীরার শ্যামনগর, নৌগেকি গ্রামে সাধু ম-লের মুদি দোকান ও বসতবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ঢেংঢোহা বাজার উত্তমের হার্ডওয়্যারের দোকান, তরুণের মোবাইল ফোনের দোকান, উজ্জ্বলের মুদি দোকান, নিতাই বাবুর চা দোকান ভাঙচুর করেছে। আগরদাঁড়ি বাজারে তাপস আচার্যের সারের দোকান, গোপল ঘোষালের বাড়ি ও মুদি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে।

বরিশাল বার্তা পরিবেশক জানান, বরিশালে ৪টি মন্দির ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

আমাদের রংপুর রিপোর্টার জানান, গত ৮ মার্চ শুক্রবার রংপুরে মন্দির ভাঙচুর ও আগুন লাগানো হয়েছে। দুইটি মন্দির ভাঙচুর শেষে আগুন লাগানো হয়।

পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে পটুয়াখালীর কলপাড়ায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। ভাচুর ও লুটপাটের সময় শিশুসহ ৫ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ৩ বছরের শিশু অপর্না রেহাই পায়নি। ঘটনার পর থেকে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে এখনও জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসী তা-ব থেমে নেই। যার কারণে হিন্দু নাগরিকদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।

Reference