যত দোষ নন্দ ঘোষ!

একটি পুরনো প্রবাদ আছে ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’ এই ব্যাটা নন্দ ঘোষ কী আসলেই যত দোষের গোড়া? সে বিষয়টি খুঁজতে হলে পেছনে যেতে হবে। এ লেখাটি আসলে যখন লিখতে শুরু করেছি, ঠিক তখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নন্দ ঘোষদের ওপর চলছে অমানবিক অত্যাচার। কারণ কী? ‘৭১-এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদ- দিয়েছে। যার বিরুদ্ধে মানুষ খুন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সেই ঘাতক দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বাঁচাতে হবে। আইনের তোয়াক্কা করে না এই শ্রেণী। কোর্ট রায় দিয়েছে তারা তা মানে না। তারা এ দেশে আজ নতুন নয়, বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই এই সাম্প্রদায়িক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এদের হাতে কেউ কখনো নিরাপদ ছিল না, এখন তো নেই-ই।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এ শ্রেণী বলেছিল, ‘হিন্দুর জন্য হিন্দুস্থান আর মুসলমানের জন্য পাকিস্তান।’ এই দ্বিজাতি-তত্ত্ব বলে সেদিন মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়েছিল। দেশ বিভাগের পরে কি পাকিস্তানে কোন হিন্দু ছিল না? যদি না-ই থাকে, তাহলে সেখানে তখন সংখ্যালঘু ছিল কারা? এ প্রশ্নের কোন জবাব ওই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিতে পারবে না। কারণ তারা একটা বিষয়ই জানে, তাদের মতবাদের বাইরে যারা অবস্থান করবে, তারাই বিধর্মী। আর এ কথাটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সব সময়ই বলে যাচ্ছে। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে আজ অবধি এই ভূ-খ-ে যখনই রাজনৈতিক কোন সহিংসতা শুরু হয়, তখনই এর শিকার হয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। আরেকবার তা প্রমাণিত হলো গত দুদিন থেকে শুরু হওয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র থেকে।
দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে এ দেশের ক্ষমতায় যারা আসে, তারা ক্ষমতার মসনদ পাকা করতে এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৮২, অর্থাৎ স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতারোহনের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে সংখ্যালঘুরা নির্মমভাবে নির্যাতিত হলেও সব মুখ বুঁজে সহ্য করে নিয়েছে। কারণ দেশ স্বাধীনের সময় যে সেস্নাগান ছিল তা হলো; এ দেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার। এ সেস্নাগানকে বুকে ধারণ করে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ‘বুক ফাটলেও, মুখ ফোটেনি কখনো।’ ক্ষমতায় সেনাবাহিনী ভেবে সংখ্যালঘুরা একটু হলেও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাস্তব বড়ই নিষ্ঠুর। স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে ‘৮০-এর দশকের শেষ দিকে দেশে চরম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিলেন। দেশের অনেক জেলায়ই সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরা সে সময় নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে লাগল। দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে মন্দির ভাঙা হলো। একরাতে হিন্দু অধ্যুষিত জেলাগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার শুরু হলো তা কয়েকদিন পরে থেমে গেলেও ওই সব এলাকায় হিন্দু জনগোষ্ঠী কমে গেল। তেমনি করে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে এ সাম্প্রদায়িক জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ বিএনপি ক্ষমতাভার গ্রহণ করার পরেই দেশের বিভিন্ন জেলায় আবারও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন। মন্দিরে অগি্নসংযোগ, মন্দির ভাঙচুর, হিন্দু নারীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, ৮ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোলা অঞ্চল। এর পরে যে সব এলাকায় হিন্দুদের বসতি বেশি সেখানে শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। এ নির্যাতনের শিকার হয়ে হিন্দুরা বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আবার অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এমনি কয়েকটি বিষয় পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানালাম। ২১/১১/২০০৪ ‘রামচন্দ্রপুরে বিএনপি নেতা সন্ত্রাসী রহিম খুনের জের, ৪ ইউনিয়নের লোকজন বাড়ি ছাড়া : এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব’ (দৈনিক সংবাদ), ১৯/১২/২০০৩ ‘হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের এখন প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে’ (দৈনিক সংবাদ), ৪/৫/২০০৩ ‘ভা-ারিয়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে ১টি সংখ্যালঘু পরিবার’ (দৈনিক সংবাদ), ২৪/১০/২০০১ ‘পিরোজপুরে নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি : সংখ্যালঘু আর আ’লীগ নেতাকর্মীরাই টার্গেট : হামলা অব্যাহত : পূজা না করার সিদ্ধান্ত (দৈনিক সংবাদ), ১০/৬/২০০৩ ‘মনে ভাববো এ দেশ আমাদের জন্য নয় : মোড়েলগঞ্জের পল্লীতে ধর্ষণ শেষে হত্যার শিকার সবিতার স্বামী পালিয়ে বেড়াচ্ছে’ (দৈনিক সংবাদ), ‘বাগেরহাট ট্র্যাজেডির লোমহর্ষক বর্ণনা : নিহত ধর্ষিত পরিবারের মানষিকতা নেই এদেশে থাকার : ক্ষোভ, আতঙ্ক, লজ্জায় বিমর্ষ তারা’ ৩/১১/২০০১ ‘মাকে সন্তুষ্ট করতে নয়, বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতেই এ পূজা’ (দৈনিক সংবাদ)। এমনি হাজারও ইতিহাস রয়েছে ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দেশের হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের। অথচ বিএনপিতে রয়েছে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, গৌতম চক্রবর্তী কিংবা নিতাই রায় চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তিরা। তারা কি শুধু বিএনপির কাছ থেকে ফায়দা লোটার জন্য বিএনপি করেন, নাকি তার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। অবশ্যই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাহলে উপরোক্ত ঘটনাগুলো ঘটতো না। তারা জোরালো গলায় এর প্রতিবাদ করতে পারতেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দেশের কুখ্যাত রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দিলু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে নোয়াখালীর রায়পুর এবং বেগমগঞ্জ, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কোটচাঁদপুরসহ আরও কয়েক স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, অগি্নসংযোগ এবং মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর দ্বারা কি প্রমাণিত হয় না, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৮০’র দশক, ২০০১ এর চিহ্নিত সাম্পদায়িক গোষ্ঠীই সমসাময়িক সময়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে না? অবশ্যই তারাই এ ঘটনা ঘটাচ্ছে।
তাহলে কি প্রমাণিত হয়, এ দেশ কি আসলে হিন্দুদের জন্য? সরকারি এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৯০১ সালে এই ভূ-খ-ে ৩৩% হিন্দু ছিল। আর ২০০১ সালে এসে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯% এ। অথচ অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা ১০০ বছরে অনেক গুণ বেড়েছে। কমেছে শুধু হিন্দু। নির্যাতনের কারণেই তারা দেশ ত্যাগ করে যুগে যুগে। কারণ যখন দেশে রাজনৈতিক সমস্যা, তখনই এ হিন্দুদের ওপর নির্যাতন। যে কারণে এ দেশের হিন্দুরা আসলে নিজেদের আর নিরাপদ মনে করে না বলেই দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যখন জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং জামায়াতকে সহায়তাকারী সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়, ঠিক তখনই ইসলামী ব্যাংক সব পত্রিকায় বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে, তারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এখানে একটি প্রশ্ন না করলেই নয়, তা হলো দেশে ইসলামী ব্যাংকের সব শাখার মধ্যে কি একজনও হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান রয়েছে? আমার জানামতে নেই। কারণ তারা এদেরকে বিধর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। এ বিধর্মীদের তাদের ব্যাংকে চাকরি দেয়া যাবে না। আর যখনই সমস্যা অনুভব করছে, তখনই তারা অসাম্প্রদায়িক ব্যাংক হিসেবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা না বললেই নয়। গ্রাম্য ভাষায় আরেকটি প্রবাদ রয়েছে ‘মার চেয়ে মাসীর দরদ বেশি।’ সাঈদীর বিষয়ে এটি একান্তই প্রযোজ্য। সাইদীর জন্মস্থান পিরোজপুরের ইন্দুরকানী। পরবর্তীতে বেগম জিয়াকে খুশি করতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জিয়ানগর। সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পরে পিরোজপুরের সর্বত্র এমনকি তার জন্মস্থান ইন্দুরকানীতেও আনন্দ মিছিল হয়েছে, হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। এখন পর্যন্ত সেখানে আনন্দের বন্যায় ভাসছে। আর দেশের অন্যান্য জেলায় তার রায়ের প্রতিবাদে মিছিল, হরতাল, মন্দিরে অগি্নসংযোগ, হিন্দু বাড়িতে হামলা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লোক মারা যাচ্ছে। অথচ পর পর দু’বার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়া পিরোজপুরে কি তার দ্বারা কোন লোক সুবিধা আদায় করেনি? কোথায় আজ সেসব সুবিধাভোগীরা? আসলে বিষয়টা অন্যত্র। পিরোজপুরের মানুষ জানে ‘৭১-এ সাঈদীর কুকীর্তি। যে কারণে তারা সুবিধা আদায় করে নিলেও সাঈদীর ফাঁসির ব্যাপারে কোন কথা বলছে না। যে সব এলাকার মানুষ জানে না, সাঈদী কতটা ভয়ঙ্কর রাজাকার ছিল, শুধু তারাই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিচ্ছে। কারণ এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জানে না সাঈদীর কুকীর্তি।
দেশে এই ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটার পরেও বিএনপি প্রধান বেগম জিয়া এই ঘটনার নিন্দা না জানিয়ে বরং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে উস্কিয়ে দিলেন। তিনিও জামায়াতের ডাকা হরতালের সঙ্গে একদিন হরতাল বাড়িয়ে দিলেন। প্রমাণ করলেন ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক ঘটনাকে আরেকবার দেশে চালানো যায় কিনা? বোঝা দরকার এখন দেশের প্রায় সব মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের অপেক্ষায়। সেখানে এ সব কুটচাল কতটা কাজে আসবে তা বোঝা দরকার।
সর্বোপরি বলতে চাই, দেশে সরকার রয়েছে, আইন রয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। তারপরেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর এই নিষ্ঠুর অত্যাচার কি করে হয়? সরকার চাইলে এর কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে। আসলে বুঝতে হবে যে, ‘আবার শর্ষের মধ্যে ভূত নেই তো?’ কারণ এ দেশের সংখ্যালঘুরা আর যাতে দেশ ত্যাগ না করে সেজন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর যদি এই পরিস্থিতি ঠেকানো না যায়, তাহলে দেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে আর প্রতিনিয়িতই সংখ্যালঘুরা এ দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে।

Reference