স্বীকৃতি নেই রাষ্ট্রের : দলিত ও আদিবাসী কড়া সমপ্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধা কিনু ও থপানের অনাহারী জীবন

কিনু কড়ার অনেক বয়স। সত্তরের কম নয়। বয়স সঠিক বলতে না পারলেও এটা বলেন যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স আটাশ/তিরিশের মতো ছিল।

তার শরীর অনেকটা হাড্ডিসার। চোখ কোটরাগত। ক্ষুধায় কাতর। কখনো খাবার জোটে, কখনো জোটে না। কখনো উদর পূর্তি হয়, কখনো উপোস। দিনাজপুরের কড়া সমপ্রদায়ের সবার যা অবস্থা তার চেয়ে কিনু কড়ার অবস্থা একটুও ভালো না। অথচ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত!

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় গ্রামে কড়া সমপ্রদায়ের বসবাস। হালজায়ের যে জায়গাটিতে দলিত ও আদিবাসী কড়ারা থাকেন সেটি ‘কড়াপাড়া’ নামে পরিচিত। এ পাড়ার একটি জীর্ণ কুটিরে কিনু কড়ার বসবাস।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ২/৩ মাস পর কড়া পাড়ার প্রায় সবাই ভারতে চলে যায়। এখান থেকে সীমান্ত কাছে, ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে। কড়াদের তাই ভারতে যেতে সমস্যা হয়নি। তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কিনু কড়া, তার আপন ভাই বাবু কড়া, আরেক ভাই সাঁতান কড়া, প্রতিবেশী গোপাল কড়া ও তার ভাই থপাল কড়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে কিনু কড়া বলেন, যুদ্ধ শুরুর ২/৩ মাস পর আমরা সাটিমারি সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাই। ভারতীয় সীমান্তের কদমপুরে আমাদের আত্মীয় এন্ডুয়া কড়া ছিলেন। আমরা তার বড়িতে আশ্রয় নেই। এর ক’দিনের মধ্যে জজ ভাই (মরহুম জজ দাস, মুক্তিযুদ্ধে শিববাড়ি ক্যাম্পের সংগঠক, দিনাজপুর শহরের মিশন রোডে বাড়ি) আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমাদের বলেন, ‘শুধু শুধু এখানে থেকে কি লাভ? মুক্তিযুদ্ধে যোগ দে, দেশের জন্য কাজ কর।’ জজ ভাইয়ের কথা ও অনুপ্রেরণায় আমি, আমার ভাই বাবু কড়া, আরেক ভাই সাঁতান কড়া এবং প্রতিবেশী গোপাল কড়া ও থপাল কড়া শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হই। ভারতের গঙ্গারামপুরে রাইফেল, গ্রেনেড, ব্রেনগান, স্টেনগান, এসএলআর চালানোর ট্রেনিং গ্রহণ করি। জজ ভাই আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। আমাদের মধ্যে সাঁতান কড়া শিলিগুড়িতে ট্রেনিং গ্রহণ করে।

কড়া সমপ্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালায়। একটি অপারেশনে শহীদ হন বাবু কড়া। এই অপারেশনটি হয় দিনাজপুর সদরের খানপুর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে।

থপান কড়া মুক্তিযুদ্ধে একটি অপারেশনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জানান, তিনি ট্রেনিং নিয়েছিলেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। অক্টোবরের শেষে কিংবা নভেম্বরের প্রথম দিকে নুরুল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে তিনিসহ পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা ঘুঘুডাঙ্গা স্কুলপাড়ায় (ঘুঘুডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়, দিনাজপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ দিকে পুনর্ভবা নদীর তীরে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধকালে এই স্কুল ভবনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল) অপারেশনের জন্য রওনা হন। পথে চকেরদিঘীতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি হয়। অপারেশনের সময় থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়।

দলিত ও আদিবাসী কড়া সমপ্রদায়ের দুই মুক্তিযোদ্ধা কিনু কড়া এবং থপাল কড়া মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। তারা থাকেন চরম দারিদ্র্যে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা কিছুই পান না।

কিনু কড়া বলেন, ‘হামার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট হেল। কিন্তুক বড় বান কুনার সময় হেরার গেল। (আমাদের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ছিল, কিন্তু বড় বন্যার সময় হারিয়ে গেছে।’

কিনু ও থপাল দুজনের কাছেই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের স্বাক্ষরযুক্ত সার্টিফিকেট ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা জজ দাসও তার স্বাক্ষরে মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যায়নপত্র দিয়েছিলেন। ১৯৮৮ ইং সালে দিনাজপুরে সংঘটিত বড় বন্যায় মাটির ঘর পড়ে গিয়ে এবং পানিতে ভিজে ওই সনদ নষ্ট হয়ে যায়।

কড়ারা বাংলাদেশের একটি দলিত ও ক্ষুদ্র আদিবাসী সমপ্রদায়। মাত্র ২২টি পরিবারের শ’খানেক সদস্য নিয়ে এই সমপ্রদায় নিভু নিভু অবস্থায় বাংলাদেশে টিকে আছে। ক্ষুদ্র এই জাতি-গোষ্ঠীর পাঁচ মুক্তিযোদ্ধার একজন বাবু কড়া শহীদ হন একাত্তরে। আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাঁতান কড়া তীব্র অভাব-অনটনের মুখে ভারতে চলে গেছেন। গোপাল কড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিং নেয়ার পর আর যুদ্ধে যাননি। কিনু ও থপাল মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের সনদ ছিল। সেই সনদ নষ্ট হয়েছে বন্যায়। অজ্ঞতা ও আদিবাসীদের স্বাভাবিক সরলতাজনিত কারণে তারা আবারও সনদ সংগ্রহের কোন চেষ্টাই করে নাই। দলিত, ক্ষুদ্র ও বিলুপ্তপ্রায় কড়া জাতিসত্তার এই দুই মুক্তিযোদ্ধার পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার। দূর করা দরকার তাদের অভাব অনটন।

Reference