হিন্দু নারীর সম্পত্তি লাভের অধিকার, মানবাধিকার

বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইনগত কোন অধিকার না থাকায় নারীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মান্ধাতা আমলের সেই আইনকে অাঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে হিন্দু নারীরা। সমাজে এখনও তারা মুখ বুজে সহ্য করছেন শত নির্যাতন। তার পরেও আইনি বিধান না থাকায় পারছেন না কোন প্রতিবাদ করতে। ধর্মমতে অগি্নসাক্ষী রেখে হিন্দু নারীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। এর পরে ওই নারী যদি দেখে তার স্বামী কোন না কোনভাবে তার প্রতি আসক্ত নয়, তথাপিও সে তার স্বামীকে আইনগতভাবে ছাড়তে পারছে না। শুধু তাই-ই নয়, বিয়ের পরে একটি হিন্দু নারীর আর পিতার সংসারে কোন অধিকার থাকে না। তেমনিভাবে স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হলেও পিত্রালয়ে ফিরে যেতে পারেন না। বিয়ের কারণে পিতার কোন সম্পত্তির ভাগই তিনি পান না। উত্তরাধিকার আইনে নারীর কোন অধিকার না থাকায় সে পিত্রালয়ে যেমন নিগৃহীত, তেমনি স্বামীর সংসারেও থাকে মুখ বুজে। একইভাবে দত্তক আইনে নারী পারে না কোন দত্তক নিতে। পাশাপাশি কোন মেয়ে শিশুকে দত্তক দেয়া কিংবা নেয়া যাবে না। কিংবা কোন নারী দত্তক নিতেও পারবেন না, দিতেও পারবেন না। নেই ডিভোর্স আইন কিংবা বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ আইন। এটি এক প্রকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাইতো এক কথায় বলা যায়, সম্পত্তি লাভের অধিকার হিন্দু নারীর মানবাধিকার। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় এমনি নির্যাতিতরা তাদের দুঃখের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সে সব কেস স্ট্যাডি নিচে তুলে ধরা হলো।
কেস স্ট্যাডি-১ : নারায়ণগঞ্জের কাজরী রানীর কন্যা সন্তানের পিতার দায়িত্ব কে নেবে ?
নারায়ণগঞ্জেরই এক বিবাহিতা হিন্দু নারী কাজরী রানী (পাতানো নাম)। বিয়ে হয় ১৯৯৭ সালে। স্বামী হরলাল সিকদার (পাতানো নাম) মোটামুটি কর্মঠ। অভাবের সংসার হলেও সংসারে সুখ ও শান্তি ছিল। বিয়ের বছরখানেক পরে জানতে পারে যে, তার স্বামী সন্তান ধারণে অক্ষম। তখন সে তার স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে আপত্তি জানিয়ে মহিলা আইনজীবী সমিতির কাছে আসে। এ পর্যায়ে ওই নারীর পিতা-মাতার মাধ্যমে আইন না থাকলেও মানবতার স্বার্থে একটি ‘ডিভোর্স’ এফিডেভিট দিয়ে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয় আত্মীয়ের কাছে। বেশ কিছু দিন সেখানে থাকার পরে তার পুনরায় বিয়ে ঠিক হয় এক ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে। বিয়ের সময় তার বাংলাদেশে বিয়ের কথা জানানো হয়। জেনেশুনেই ওই যুবক নিরাঞ্জন দাস (পাতানো নাম) তাকে বিয়ে করতে উৎসাহিত হয়। বিয়ের সময় তাকে ওই ডিভোর্স এফিডেভিট দেখানও হয়। তবে শর্ত হলো প্রতিমাসে স্বামীকে ভারতীয় অর্থে দু’হাজার করে টাকা পাঠাতে হবে। এমনিভাবে প্রতিমাসে কাজরীর পিতা তার সাধ্যানুযায়ী টাকা পাঠাতে থাকে। হঠাৎ করে শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক অসুবিধার জন্য টাকা পাঠাতে না পারায় ওই স্বামী নিরাঞ্জন তার ওপর নির্যাতন শুরু করে। শুধু নিরাঞ্জন একাই নয়, তার পিতা, মাতা, ভাই, বোন সবাই তাকে নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা এমন পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছায়, অবশেষে ওই নারীর আত্মীয়-স্বজনরা বাধ্য হয়ে কলকাতা কোর্টে মামলা করে। এই মামলায় স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। এরই মাঝে দ্বিতীয় স্বামী নিরাঞ্জন ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে যোগাযোগ করে তার প্রথম স্বামী হরলালের সঙ্গে। প্রথম বিয়ের যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করে নিয়ে গিয়ে জামিন নেয়। সেখানে প্রমাণ করা হয়, ওই নারীকে তার দ্বিতীয় স্বামী বিয়েই করেনি। এমনকি তাকে চেনেও না। হায়রে নিয়তি, দেশান্তর হয়েও পার পেল না কাজরী। পরে অগত্যা সে আবার বাংলাদেশে তার পিতা-মাতার কাছে চলে আসে। এরই মাঝে তার গর্ভে দ্বিতীয় স্বামীর আসা কন্যা সন্তান আলোর মুখ দেখে। ফলে তার প্রথম স্বামীও আর তাকে মেনে নিতে রাজি হয়নি। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে মহিলা আইনজীবী সমিতি বিষয়টি তাদের গোচরে নিয়ে তার আত্মহত্যার পথ অন্তত রোধ করল। ওই নারীর পিতা-মাতা এমনকি ভাইয়েরাও এখন আর তাকে দেখতে চাচ্ছে না। এর পরিণতি আসলে কী? বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইন না থাকায় উক্ত নারী কাজরী আইনের ফাঁক-ফোকরেও সংসার চালাতে পারল না। বর্তমানে একমাত্র কন্যাসন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার পথ দেখছেন। কিন্তু ওই সন্তান বড় হলে কে হবে তার পিতা। এই প্রশ্ন কাজরী রানীর।
কেস স্ট্যাডি-২ : ২৫ বছর ধরে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছেন নাটোরের স্বামী পরিত্যক্ত বাসন্তী রানী
২৫ বছর পূর্বে বিয়ে হয়। এক বছরের মাথায় একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। এর পরেই স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। দীর্ঘ ২৪ বছর স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে পুত্রসন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছেন বাসন্তী সাহা। নাটোর জেলা শহরের শুকুলপট্টি এলাকার দিনমজুর সুব্রত সাহার সহধর্মিণী বাসন্তী সাহা। ১৯৮২ সালে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় বাসন্তীর পিতা সাধ্যানুযায়ী উপঢৌকন দিয়েছে তাকে। কিন্তু এর পরেও বিপত্তি। বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায়ই একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন বাসন্তী। এরপর থেকেই ওই সন্তানের পিতা উধাও। পরে জানা গেল সিরাজগঞ্জে গিয়ে আরেকটি বিয়ে করে সংসার শুরং করেছে। এক্ষেত্রে কোন ভরণপোষণ, খোরপোষ কিছুই পায়নি বাসন্তী রানী। পুরুষশাসিত এ সমাজে সে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছিল। এমনি সময় এলাকার কিছু সমাজপতি তাকে স্থানীয় বঙ্গজল উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে আয়া পদে চাকরি দিয়ে দেন। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছেলেকে বড় করেছেন বাসনন্তী রানী। এখনও ওই স্কুলেই চাকরি করেন। স্বামীর কাছে ভরণপোষণ, খোরপোষ চেয়েও কোন লাভ হয়নি। অগত্যা তিনি ভুলেই গেছেন যে, তার স্বামী ছিল। তথাপিও স্বামীর স্মৃতি হাতে শাঁখা ও সিঁথিতে সিঁদুর নিয়েই তিনি আমৃত্যু বেঁচে থাকতে চান। হিন্দু পারিবারিক আইন না থাকায় বাসন্তী রানীরা এমনি সমস্যার শিকার। তিনি ওই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বলেন, অবশ্যই হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। যাতে করে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে প্রয়োজনমাফিক প্রাপ্য পেতে পারে আর কন্যাসন্তানরা পিতৃপরিচয়ের পাশাপাশি সম্পত্তির অধিকার পেতে পারে।
কেস স্ট্যাডি-৩ : হিন্দু পারিবারিক আইন না থাকায় স্বামী ও পিতার সংসার থেকে ঝরে পড়ল গাজীপুরের সাবিত্রী
গাজীপুর পৌর এলাকার রাজবাড়ি সংলগ্ন রসময় হালদারের কন্যা সাবিত্রী হালদার। দীর্ঘ ১২ বছর স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে নিজ বাহুবলে একমাত্র কন্যাকে বড় করছেন। ১৯৮৪ সালে বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী কালিয়াকৈর এলাকার সমীর হালদারের সঙ্গে। বিয়ের ৮ বছর পরে কন্যাসন্তান জন্ম দেন সাবিত্রী হালদার। এই কন্যাসন্তান জন্ম দেয়াটাই তার অপরাধ। এ কারণে স্বামী সমীর তাকে নিয়ে আর সংসার করতে রাজি হলো না। একপর্যায়ে শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের শিকার সাবিত্রী তার একমাত্র কন্যাকে নিয়ে পিত্রালয়ে চলে আসে। পিতা তাকে আগের মতই কন্যা স্নেহে কোলে তুলে নিলেন। এ বিষয়টি ভালো চোখে দেখল না সাবিত্রীর ভাইয়ের বউ। সে ননদের এই সংসারে থাকাটা পছন্দ করল না। তবুও শ্বশুরের কারণে কিছুই বলতে সাহস পাচ্ছিল না। ইতোমধ্যে রসময় হালদার মারা যান। দুঃখ নেমে আসে সাবিত্রীর জীবনে। ভাইয়ের সংসার। মাও কিছু বলতে পারে না। ভাইয়ের বউ তাকে কোন প্রকারেই মেনে নিতে পারছিল না। সারাদিন গালমন্দ করতেই থাকে। সাবিত্রীর একমাত্র মেয়েটিকেও মারধর করে। একপর্যায়ে সে পিত্রালয়ে মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো জমি চায়। কিন্তু তাতেও রাজি হলো না পিত্রালয়ের কেউ-ই। সবারই এক কথা, ‘তোমার বিয়েতে সবকিছুই দিয়ে দেয়া হয়েছে।’ সাবিত্রী আবারও তার স্বামীর কাছে যায়। কিন্তু তাকে মেনে নিতেই সে অস্বীকৃতি জানায়। সাবিত্রী তখন আশ্রয় নেয় মহিলা পরিষদের কাছে। মহিলা পরিষদের সিদ্ধান্তানুযায়ী স্বামীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে সাবিত্রী একটি সেলাইর মেশিন নিয়ে গাজীপুরের এক অজপাড়াগাঁয়ে একটি ছোট দোকান দিয়ে বসে। এভাবে কোনমতে দিন আনে দিন খেয়ে মেয়েটিকে লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। তার মেয়ে এখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। কথা হয় সাবিত্রীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইন না থাকায় আজ আমার কপালে স্বামী এবং পিতার কোন সংসারেই একটু ঠাঁই মিলল না।’ তিনি এ পরিস্থিতির হাত থেকে বাংলাদেশের নারীদের রক্ষা করতে অচিরেই হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার করা হোক বলে মত দেন।

Reference