আবাসন সমস্যায় মানবেতর জীবনযাপন করছে গণকটুলীর দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা

রাজধানী ঢাকা শহরের হাজারীবাগ এলাকার গণকটুলী সিটি কলোনী হরিজন সম্প্রদায়ের একটি প্রাচীন আবাসভুমি। সনাতন ধর্মাবলম্বী হরিজনরা এই কলোনীতে স্বাধীনতার পূর্ব থেকে বসবাস করে আসছে। বেসরকারি জরিপ মতে, এই কলোনীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭০০০ এর ঊর্ধ্বে। কিন্তু কলোনীর অধিবাসীরা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বসবাস করেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সুবিধাসমূহ থেকে বঞ্চিত। আবাসন সমস্যা, জলাবদ্ধতা, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানাবিধ সমস্যায় তারা জর্জরিত। মানবেতর জীবনের এক মরণ ফাঁদ যেন এই হরিজন কলোনী।

গণকটুলী সিটি কলোনীর আবাসন সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে গিয়ে নানা অসঙ্গতির চিত্র তুলে আনে শারি সংস্থার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গণকটুলীতে বসবাসকারি মানবাধিকার সুরক্ষা কর্মীবৃন্দ।

বর্তমানে এই এলাকায় ৫টি পুরাতন ভবন রয়েছে। এই ভবনগুলোর প্রতিটিতে ৪টি করা তলা রয়েছে। হরিজন সম্প্রদায়ের বসবাসের জন্য প্রতি পরিবারকে ১০ ফুট চওড়া এবং ১৩ ফুট লম্বা আকারের একটি করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এসব ঘরে একটি ছোট রান্নাঘর এবং একটি ছোট বারান্দা থাকলেও নেই কোন পায়খানা কিংবা স্নানঘর। প্রতি তলার দুই পাশে ৪টি করে মোট ৮টি টয়লেট ছিল। এর মধ্যে ৪টি পুরুষ এবং ৪টি মহিলা টয়লেট। এই টয়লেটগুলোর বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাসস্থান সংকটের কারণে প্রতি তলার প্রায় ২টি করে টয়লেট ভবনবাসী বসবাসের জন্য ব্যবহার করায় সেখানে টয়লেটের পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়াও স্থানী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিটি ভবনের বেশ কিছু টয়লেটকে তাদের ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে। এই ব্যবসার মধ্যে রয়েছে মদ বিক্রি, শুকর পালন ইত্যাদি। এতে করে ভবনবাসী ঐ সমস্ত বাথরুমগুলোও আর ব্যবহার করতে পারছে না। এমনকি এই সকল অবৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য ভবনের স্বাভাবিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রান্নাঘর এবং বারান্দা বাদে যে ছোট কক্ষটি থাকে তাতে প্রতি ঘরে প্রায় ৮ থেকে ১৩ জন মানুষ বসবাস করে। এমন অসংখ্য পরিবার পাওয়া যাবে যেখানে মা-বাবা, পুত্র-পুত্রবধু এবং নাতি-নাতনিসহ একই ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক ব্যক্তিজীবনের অধিকার এবং বিকাশের রাস্তা এখানে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। ফলে দিন দিন বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। এমনও দেখা যায় এসব পরিবারের সদস্যরা রাতে পালা করে ঘুমাতে যান। এত ছোট ছোট ঘরে থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়া এবং অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্ম করা আধুনিক জীবনের যে কোন মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব। কোন স্নানঘর না থাকায় বারান্দাকেই বাড়ির বউ-ঝিরা স্নানঘর হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়া পানি ব্যবহারের জন্য যে একটিমাত্র বড় চৌবাচ্চা রয়েছে সেখানে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সকলেই একসাথে স্নান এবং প্রয়োজনীয় কাজ করতে বাধ্য হয়। বাসস্থান সমস্যা নিরসনে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব ঘরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনুমতিবিহীন বেশ কিছু কাঁচা-পাকা ঘর বানিয়ে থাকছে এলাকাবাসী। এসব ঘর খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং বসবাসের একেবারে অনুপোযোগী।

দীর্ঘদিন গ্যাস সংযোগ না থাকলেও ২০১৩ সালের মার্চ মাসে কলোনীতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। কিন্তু দিনের একটি দীর্ঘ সময় গ্যাস পাওয়া যায় না। প্রায়শই সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কলোনীতে গ্যাস থাকে না। তাই রান্না-বান্নার কাজে খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়। এছাড়া গ্যাসের পাইপ লাইনগুলো দালানের নিচে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে যে কয়েক বার পাইপগুলো বিকট শব্দে ভেঙে গিয়ে গ্যাস বের হতে থাকে। ফলে এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এর সমাধানে কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

এছাড়াও পানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যায়ও জর্জরিত এলাকাবাসী। পানি স্বল্পতার কারণে প্রতি মাসে প্রায় ২৫০-৩০০টাকার পানি ক্রয় করে ব্যবহার করতে হয় বলে জানিয়েছেন এলকাবাসী। বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনে একটি বিদ্যুৎ ঘর তৈরি করা হলেও তা মূলত পার্শ্ববর্তী মুসলিম বস্তির একচ্ছত্র আধিপত্যে থাকায় ক্ষমতার জোরে তারা প্রায় সময় হরিজন কলোনীর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে নিজেদের কলোনীর হিটার চুলাসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রতি মাসে সিটি কর্পোরেশন ১৬০০-১৭০০টাকা করে বেতন থেকে কেটে রাখলেও তারা পর্যাপ্ত সুবিধাসমূহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গত ৫০ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বরাদ্দকৃত ছোট ছোট ঘরে বসবাস করে আসলেও কোন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে দারুণ অসুবিধায় পড়তে হয় ভবনবাসীদের। তবে আশার দিক এই যে, এত সীমাবদ্ধতার পরও হরিজন সম্প্রদায়ের শিক্ষার হার বাড়ছে। ফলে অধিকার এবং সচেতনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক গতিশীলতাও বাড়ছে।

অতি সম্প্রতি টয়লেট, পানি এবং গ্যাস সুবিধাসহ এক কামরাবিশিষ্ট একটি নতুন ভবন নির্মাণ করে স্থানীয়দের বরাদ্দ দেয়া হলেও এতোগুলো লোকের জন্য তা একেবারে অপ্রতুল। তাই এলাকাবাসী আবাসন সমস্যা নিরসনে সরকারের কাছে অতি দ্রুত দুকামরাবিশিষ্ট নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন ভবন নির্মাণের জোর দাবী জানাচ্ছে।

প্রতিবেদন প্রণয়নে: দলিত হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার সৌরভ সামুন্দ, হৃদয় দাস, সঞ্চিতা রানী, বিজয়তী কেশ, আমান দাস, প্রতিভা রানী, কিষাণ সামুন্দ, স্নিগ্ধা রানী, তপু চন্দ্র দাস।