বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার গোড়ার কথা

অতিসম্প্রতি কক্সবাজার জেলার রামু, উখিয়া এবং চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে। রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় বৌদ্ধমন্দির এবং পল্লীগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পটিয়ায় একটি হিন্দু মন্দিরও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দুজন বৃদ্ধা মারাত্মকভাবে আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। দেশবাসী ইলেকট্রনিকস মিডিয়া এবং সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিত দেখেছেন, জেনেছেন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা এদেশে অতীতেও ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংঘটিত হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছিল ভারত ত্যাগের পূর্বে ব্রিটিশের ঘৃণিত কৌশল ‘ভাগকর শাসন করোর’ ফসল। বাংলায় দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়ার একটা বাস্তব পরিস্থিতি সে সময় সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও বিরাজমান ছিল, ধূর্ত ব্রিটিশ তা বুঝেছিল।
১৯৩৭ সালে ভারতবর্ষের বাংলায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এই শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য চাকরির বাজার ছিল খুবই সংকুচিত। কারণ মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায় থেকে প্রায় শতবর্ষ পরে। ফলে ব্রিটিশের কেরানির বাজারের প্রায় সবটাই হিন্দুদের দখলে ছিল। পূর্ববাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী মনে করেছিল হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলে পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেয়া যাবে এবং ‘চাকরির বাজার’ একচ্ছত্রভাবে তাদের দখলে চলে আসবে। কারণ পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ। হিন্দু সম্প্রদায়কে তাড়িয়ে দেয়ার পর তাদের স্থাবর সম্পত্তি দখলের স্বপ্ন দেখত মুসলিম লীগের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গু-াপা-ারা।
তদানিন্তন সময়ে আরও একটা বাস্তবতা ছিল পূর্ববাংলায়। ব্রিটিশ ভারতে পূর্ববাংলার দশজন জমিদারের মধ্যে নয়জনই ছিলেন হিন্দু সম্প্রাদায়ের। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক প্রজাকুল ছিল দরিদ্র মুসলমান। এই দরিদ্র কৃষক প্রজাকুল মনে করেছিল হিন্দু-মুসলমান তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হলে তারা হিন্দু জমিদারদের শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু এই দরিদ্র মুসলিম কৃষক প্রজাকুল কখনোই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দেখা গেছে পূর্ববাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের একটা অংশ অতি উৎসাহ নিয়ে দাঙ্গায় অংশ নিচ্ছে। ভারত ভাগের পর মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ সত্যি সত্যিই ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ চাকরির বাজারের নিরঙ্কুশ মালিক বনে গিয়েছিল এবং একই সঙ্গে মুসলিম লীগের গু-াপা-া হিসেবে ‘দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া হিন্দুদের’ স্থাবর সম্পত্তিও দখল করেছিল।
১৯৪৮ সাল থেকে ‘৫২ সালের মধ্যেই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের পাকিস্তান প্রীতি থেকে মোহ ভঙ্গ ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ ভূস্বামী ও সামরিক কর্তাদের স্বৈরশাসন ও জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ‘৫২ এর রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের চেতনা থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাব মুছে দিতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার ঘটনা ঘটায়। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটলেও কৃষকের জীবনের কোনই পরিবর্তন ঘটে না। গ্রাম-শহরের শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের জীবনের সংকটের কোনই পরিবর্তন আনতে পারে না সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয় এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যায়।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষে পূর্ববাংলার বাঙালির চেতনা থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ক্ষীণ হয়ে পড়লেও সমাজে তার অবশেষ বজায় ছিল। ১৯৬৪ সালে খুব অল্প পরিসরে হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আরেক দফা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ঘটাতে পেরেছিল। বাস্তবে এসব দাঙ্গা ছিল এক তরফা। মুসলিম লীগের গু-ারা হিন্দুদের ওপর হামলা চালায় এবং লুটপাট করে। পূর্ববাংলার বাম গণতান্ত্রিক শক্তি দ্রুত এই হামলা রুখে দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই মনে করেছিলেন বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় উৎপাটিত হয়ে গেছে।
সমাজে সাম্প্রদায়িকতার নানা রূপ থাকে। পৃথিবীতে ধর্ম, বর্ণ ও জাতির মধ্যে নানা ধরনের বিভেদ ও বৈষম্য শতবর্ষ ধরে বিরাজ করছে। ফলে সমাজ জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণ মুছে যায় না। নানা ধরনের সংকীর্ণ স্বার্থ, বিশেষ করে হীন রাজনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থে শাসকগোষ্ঠী অথবা প্রভাবশালীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত উসকে দেয়া হয়। পশ্চাৎপদ ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে সাময়িক সময়ের জন্য উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাস্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টি করা যায়।
১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মদতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনরায় শুরু করা হয়। একটানা দুই দশক ধরে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার জন্য সবকিছুই করা হয়েছে। এসবই করা হয় জিয়া-এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের ছত্রছায়ায়। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত শাসনকালে সাম্প্রদায়িকতা সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গিবাদে রূপান্তরিত হয়। এতসব সত্ত্বেও বাংলাদেশে জঙ্গি সাম্প্রদায়িকতা কর্তৃত্বশালী হয়ে উঠতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিঘাত এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনও সামাজিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র আক্রমণকে রুখে দিতে সক্ষম হচ্ছে।
বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির পেছনে বৈষয়িক স্বার্থ চিন্তা প্রধান কারণ হিসেবে এখনো বিরাজ করছে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর রাজধানী ঢাকা শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে যে বড় সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায় দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান তাদের মূল্যবান সম্পত্তি একশ্রেণীর মুসলমান প্রভাবশালী টাউট ভুয়া দলিল করে ভোগ দখল করছে। আজও যদি সুষ্ঠু তদন্ত করা হয় তাহলে এই দখলদারদের চিহ্নিত করা সম্ভব। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শুরুতে যে দাঙ্গা ঘটেছিল তাতে প্রায় নয় লাখ হিন্দু সম্প্রদায় দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। তদন্ত করলে দেখা যাবে তাদের সহায় সম্পদও নানা কৌশলে দখল করে নিয়েছে দাঙ্গা সৃষ্টিকারীরা। মহাজোট সরকারের আমলেও সাতক্ষীরা, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরসহ কয়েকটি অঞ্চলে হিন্দুদের ওপর বড় ধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটে গেছে। এর পেছনেও ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল্যবান সম্পত্তি দখলের লোভ। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে অতি সম্প্রতি পাহাড়ে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পেছনেও রয়েছে বৈষয়িক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী যখন ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়নের অন্যতম বাধা ভূমি সমস্যা সমাধানের বাস্তব উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দিলেন তখনই ঘটে গেল পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা। পাহাড়ে ‘সেটেলারদের’ কায়েমি স্বার্থের নেপথ্য নায়করা দাঙ্গা বাধিয়ে ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়ন আর এক দফা বাধাগ্রস্ত করল। একটা অদ্ভুত ঘটনা পাহাড়ে লক্ষ্য করা যায়। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোরতর বিরোধী পাহাড়ে গিয়ে তারা অবলীলায় বাঙালি বনে যায়! এক্ষেত্রে ‘বাঙালি-বাংলাদেশি’ বিরোধ কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না!
ভূরাজনৈতিক স্বার্থেও জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধ উসকে দেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সস্তা অনুভূতিকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন, হঠাৎ করে পাহাড়িরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন! এই সেদিনও তারা নিজেদের ‘জম্মু’ জাতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। জাতীয়তার বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের ধার তারা ধারছেন না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে নরতত্ত্ব বিচারে আমাদের এই ভূখ-ে তিনটি মৌলিক জাতি সত্ত্বার উপস্থিতি রয়েছে। তারা হলো_ ১. প্রোটো অস্ট্রোলাইড, ২. মঙ্গোলাইড এবং ৩. ভেড্ডিড। পাহাড়িরা হলেন ‘মঙ্গোলাইড’। তারাও বাইরে থেকে এসে এই ভূখ-ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ‘আইএলও’র সংজ্ঞা বিচারেও বাংলাদেশের জন্য ‘আদিবাসি’ টার্মিনোলজি কোনভাবেই প্রজোয্য হয় না। পশ্চিম ইউরোপীয় কিছু দেশ এবং তাদের মদতপুষ্ট কিছু এনজিও তাদের বৈষয়িক স্বার্থে এ ধরনের অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তাছাড়া ভূরাজনৈতিক স্বার্থে যারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে চায় তারাও এই ফাঁপানো তর্কের জন্ম দেয়ার নেপথ্যে রয়েছে। বাঙালি জাতিসহ যে কোন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক মানুষ পাহাড়ি ও সমতল ভূমির ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার ও প্রাণের দাবিগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করবে। নেহায়েত মতলববাজ না হলে জম্মুজাতি এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের অধিকার ও স্বার্থের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারে না।
কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা হয়ে গেল সেখানে বিদেশি স্বার্থই প্রধান বলে মনে হয়। এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আরাকানের রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমারের বৌদ্ধরা যে হামলা করেছে তার প্রতিশোধ নিতে হয়তোবা এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের খোলা অনুমতি দিতে প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে। মার্কিনপন্থি মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইট ওয়াচ’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভীষণ সোচ্চার। শোনা যায়, মার্কিনিরা মায়ানমারের আরাকান এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার সংলগ্ন কিছু এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে চায়। যে রাষ্ট্রের ওপর মার্কিনিদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় থাকবে। বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে একটি স্বাধীন দেশের বড়ই প্রয়োজন পড়েছে মার্কিনিদের, যেখানে তারা প্রকাশ্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে। গণচীনকে মোকাবিলার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে আমেরিকার এ ধরনের সামরিক ঘাঁটির প্রয়োজন রয়েছে।
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় ‘আইএসআই’, পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গায় ‘র’ এবং বৌদ্ধ-বাঙালি দাঙ্গায় ‘সিআইএ’, এ ধরনের সমীকরণ কেউ যদি করেন তাতে দোষের কিছু থাকে না বলেই মনে হয়।
বাংলাদেশের সেক্যুলার বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে আজ এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ‘হটবেডে’ পরিণত হচ্ছে। এর অবসান ঘটাতে হবে।

Reference