সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব শুভ শক্তিকে একাট্টা হতে হবে

দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা আক্ষরিক অর্থেই উদ্বেগজনক অবস্থায় পেঁৗছেছে। কি ধর্মীয় সংখ্যালঘু কি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবাই আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। লুটেরাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার যে চারা রোপণ করা হয় তা আজ বিষবৃক্ষ হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতা ছিল একমুখী, বড় দাগে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ। ভাবা হয়েছিল, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান দুই রাষ্ট্র তৈরি করে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের অবসান ঘটবে। কিন্তু তা হয়নি।
‘৪৭-এ দেশ ভাগের পর ভারতের অংশে যেমন, পাকিস্তানের অংশেও তেমন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিগত বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান অংশ পূর্ব-পশ্চিমে বিরোধটা ছিল বড় দাগে ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধর্মের ধোয়া তুলে, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করে বাংলাকে শোষণ করতে চেয়েছে। এদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দালালচক্র ছাড়া সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বিভেদের টোপ গেলেনি। সবাই একাট্টা হয়ে পাকিস্তানি সামরিক রাজনৈতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। যে কয়েকটি চেতনা নিয়ে ‘৭১-এ বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তার প্রধান একটি চেতনা হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা।
অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা নিয়ে লড়া যুদ্ধ জেতার প্রায় ৪১ বছর পর দেখা যাচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ জেঁকে বসেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে কোন সাম্প্রদায়িকতার চারা আজ এত বছর পরে বিষবৃক্ষ হয়ে উঠেছে বললে ভুল হবে না। ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতা ছিল প্রধানত হিন্দু-মুসলিম বিতর্ককে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি শোষকরাও একই বিতর্ককে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিতে চেয়েছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বহুমুখী রূপ দেখা যাচ্ছে। এখন আদিবাসীরা হামলা-নির্যাতন-হত্যা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বৌদ্ধরা হামলার শিকার হচ্ছে। পাকিস্তানি হানদাররা ‘৭১-এ নয় মাসের নৃশংসতায় যা করেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আজ তাই হচ্ছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি বলে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি জামায়াত-শিবির গতবার বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নজিরবিহীন অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়। সেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভয়াবহ স্মৃতি দেশবাসীর মন থেকে মুছে যায়নি। অনেকে মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বলেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটতে পেরেছে। এরপরও সে সময় এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এমন সর্ববিস্তারী রূপ ধারণ করেনি। তখনো কোন বৌদ্ধবিহার বা বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
বর্তমান সরকার আমলে রামু, উখিয়া, পটিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হামলার ঘটনায় অবাক না হয়ে পারা যায় না। বর্তমান সরকার নিজেকে সবসময়ই মুুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি বলে দাবি করে। অথচ তাদের শাসনামলেই সাম্প্রদায়িকতার সর্ববিস্তারি রূপ প্রকাশ পেল। এতে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের আর বিরোধী শক্তির মধ্যে ফারাকটা কোথায়। যে সরকার আমলে আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা সেই সরকার আমলে আদিবাসীদের নাম পরিচয় নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। খোদ সরকারই আদিবাসীদের নাম পরিচয় প্রশ্নে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে সরকার আমলে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা, সেই সরকার আমলে আদিবাসীরা এখনো হামলা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং সেসব হামলা-নির্যাতনের একটিরও বিচার করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা পাহাড়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সামনেই সন্ত্রাসীরা আদিবাসীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনার এক সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই গত শনিবার ও রোববার রামু, পটিয়া, উখিয়া, নাইক্ষংছড়ি প্রভৃতি এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর ও উপাসনালয় ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হলো। তাদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ও হামলার শিকার হয়েছে।
এসব হামলার পেছনে মৌলবাদী চক্র এবং রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গিদের পরিকল্পনা কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা এবং পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মৌলবাদী চক্র এবং নিষ্ক্রিয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলা হয়েছে। এ দাবি যৌক্তিক। আমরা এ দাবির সঙ্গে একমত।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও মৌলবাদীচক্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্যাতের পরিকল্পনা করে কীভাবে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সুসংঘটিত হয়ে হামলা চালিয়ে নির্বিঘ্নে সরে যেতে পারে কী করে? আর হামলার সময় প্রশাসনইবা নীরব ভূমিকা পালন করে কেন? হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর তারা কিছু গ্রেফতার আর কিছু বদলি নাটক করে ঘটনা ধামাচাপা দেয়। এসবের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটিই হচ্ছে রাজনৈতিক। ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলমাত্রই মৌলবাদী চক্রকে নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে লালন করে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের এই চিত্র বদলায়নি স্বাধীন বাংলাদেশেও। সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা করেছে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এদেশের সামরিক শাসকরা ক্ষমতায় থাকার জন্য মৌলবাদী গোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করেছে। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়ও নানান কায়দা-কৌশলে মৌলবাদী চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলো যেমন, ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোও তেমন মৌলবাদী চক্রের সঙ্গে আপসরফা করেছে। ‘৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অলিখিত সমঝোতা হয়েছিল। এক-এগারো উদ্ভবের আগে একটি মৌলবাদী দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ লিখিত চুক্তিই করে বসল। সেই চুক্তিতে ফতোয়ার অধিকারসহ উগ্র মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার অনেক শর্তই মেনে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। পরে সমাজের বিভিন্ন অংশের চাপের মুখে তিনি সেই চুক্তি ভাঙতে বাধ্য হন। বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই মৌলবাদী ঘেঁষা দল। গতবার তারা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছে। ‘৭১-এর চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক শক্তির এমন দুই ব্যক্তিকে বিএনপি মন্ত্রী বানিয়েছিল যাদের এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করা হচ্ছে। এসব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুরির পরও দলটি মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গ ত্যাগ করেনি। বরং সরকারবিরোধী যে ১৮ দলীয় জোট গড়েছে তাতে যেসব দলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেসব দলের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই উগ্র মৌলবাদের অভিযোগ রয়েছে।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শক্ত অবস্থানে নেই দেখেই গত শনিবার ও রোববার বৌদ্ধ সম্প্রদায় হামলার সহজ শিকার হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে সরকার সতর্ক নয় বলেই মৌলবাদী জঙ্গিচক্রের পরিকল্পনা সম্পর্কে সময়মতো জানতে পারে না বা জানলেও কোন ব্যবস্থা নেয় না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার দায় মৌলবাদী চক্রের ওপর চাপানোর পাশাপাশি বিপক্ষের রাজনৈতিক দলের ওপরও চাপানোর খেলা শুরু করেছে সরকার ও বিরোধী দল। আমরা মনে করি, সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে কোনভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কোন দল থাকতে পারে না। সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি-গোষ্ঠী মানবতার শত্রু। ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সবাইকে এক পতাকাতলে অবস্থান নিতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণের ঐক্য হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক চক্রের সঙ্গে আপসরফা করে চলার অপসংস্কৃতি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা সম্ভব হবে।
যে কোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখতে হবে। আমরা অসাম্প্রদায়িক শক্তির ওপর আস্থা রাখতে চাই। সরকারকে অবশ্যই দেশের সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করতে হবে, তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

Reference